ইতিহাস

নূরজাহান মুঘল নীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল

নূরজাহান মুঘল নীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল

মুঘল আমলে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সাথে জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহানের নাম যুক্ত , যদিও সমকালীন লেখকরা নূরজাহানের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে খুব সামান্যই আলোকপাত করেছেন । তুর্কি-আফগান যুগে সুলতান রাজিয়ার পর মুঘল যুগে একমাত্র নূরজাহান একটি ব্যতিক্রমী নারী হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন । মির্জা গিয়াসবেগের কন্যা নুরজাহানের আসল নাম মেহেরউন্নিসা , মুঘল কর্মচারী তথা বর্তমানের জায়গির আলিকুলি বেগের পত্নী মেহেরউন্নিসার রূপলাবণ্যে অভিভূত হয়ে জাহাঙ্গীর তার নতুন নামকরণ করেছিলেন প্রথমে ‘ নূরমহল ’ , পরে ‘ নূরজাহান ’ ।

পারসিক সংস্কৃতি শিক্ষায় শিক্ষিতা নূরজাহান ছিলেন উন্নত সংস্কৃতি ও রুচি সম্পূর্ণা মহিলা । তাঁর চরিত্রে ছিল মানবিক গুণাবলীর অপূর্ব সমন্বয় , পণ্ডিত ধর্মজ্ঞানী শিল্পী সাহিত্যিক প্রমুখের প্রতি তার ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রশংসনীয় । অনাথ ও অসহায় রমণীদের প্রতি নূরজাহানের সহমর্মিতা ছিল অভূতপূর্ব । মহম্মদ হাজি তার ওয়াকিয়াত ই জাহাঙ্গীর গ্রন্থে লিখেছেন যে , “ নূরজাহান ছিলেন পীড়িত ও অসহায় নারীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের ফল । ” ইকবাল ই জাহাঙ্গীরী গ্রন্থে মুতাম্বিদ খাঁ নূরজাহানের মানসিকতা ও দয়া প্রবণতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ।

শের আফগানের মৃত্যুর প্রায় চার বছর পর জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে বিবাহ করেন , কিন্তু রাজপ্রাসাদের বিলাস বৈভব কিংবা অন্দরমহলের সীমিত পরিধি নূরজাহানকে আটকে রাখতে পারেনি , বিচক্ষণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী নূরজাহান ধীরে ধীরে রাজকীয় কাজে হস্তক্ষেপ শুরু করেন । জাহাঙ্গীরের আলস্য এবং শারীরিক দুর্বলতা নূরজাহানের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে দেন , মুতাম্বিদ খাঁ লিখেছেন , রাষ্ট্রীয় কাজে নূরজাহানের উত্থানের পশ্চাৎপটে জাহাঙ্গীরের সচেতন প্রয়াস সক্রিয় ছিল , সম্রাট স্বয়ং নূরজাহানের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন এবং সরকারি নির্দেশনামায় নিজ নামের পাশে ‘ নূরজাহান ’ , ‘ বাদশা বেগম ’ উল্লেখ করে রাজনীতির অঙ্গনে তার পদচারণা শুরু করে দেন ।

বস্তুত , নূরজাহান অভিজাতদের সাথে রাজনৈতিক শলাপরামর্শ , কিংবা হাতির পিঠে চড়ে বাঘ শিকার করা , কিংবা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করার কাজে বিস্ময়কর সাহস ও দক্ষতা দেখায় । যে – কোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার করায়ত্ব । খুব সহজেই তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করতে পারেন । প্রসঙ্গত স্মরণীয় , সম্রাট তথা স্বামী হিসাবে জাহাঙ্গীরের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম ও আন্তরিক । ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করলেও সম্রাটের মর্যাদাহানিকর কোনো সিদ্ধান্ত তিনি কখনোই নেননি । ফলে মুঘল সাম্রাজ্য তথা জাহাঙ্গীরের জীবনে নুরজাহানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মোটামুটিভাবে সুফলদায়ী ছিল ।

নূরজাহানের ক্ষমতার উৎস ছিলেন জাহাঙ্গীর । কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ও প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তার প্রধান সহায় ছিলেন পিতা মির্জা গিয়াসবেগ , ভাই আসফ খাঁ , শাহাজাদা খুররম( শাহাজাহান ) প্রমুখ । এদের সম্মেলনে যে চক্র গড়ে উঠে , তা নূরজাহানের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করেছিল । নূরজাহান তার প্রথম পক্ষের কন্যা লাভলী বেগমের সাথে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়রের বিবাহ দিলে খুররম ক্ষুব্ধ হন । নূরজাহান শাহরিয়রকে সিংহাসনে বসিয়ে খুররমকে জ্যেষ্ঠ পুত্র থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন , এমন ধারণা থেকে শাহজাহান নূরজাহান চক্র ভেঙে বেরিয়ে যান । পিতা গিয়াসবেগের মৃত্যু এবং খুররমের নিস্পৃহতার ফলে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দের পর নূরজাহান স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী হন । এই সময় তার কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত অভিজাতদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিরূপতার সৃষ্টি করে , সম্রাট জাহাঙ্গীর তখন এতটাই শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন যে , শুভ ও অশুভবোধ কিংবা দায়িত্ব সচেতনতা সামান্যভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ ছিলেন । ইনতেখাব    জাহাঙ্গীরশাহি গ্রন্থে বলা হয়েছে যে , “ সম্রাট নূরজাহানের প্রভাবে এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে , মোহাব্বত খাঁ’র মতে দুই শতাধিক অভিজাতের আবেদনও তাকে প্রভাবিত করতে পারত না । ”

নূরজাহান শাহজাহানকে কান্দাহার যাত্রার নির্দেশ দিলে শাহজাহান বিদ্রোহী হন । মহাব্বত খাঁ দক্ষতার সাথে সেই বিদ্রোহ দমন করে । কিন্তু ভ্রান্তিবশত নূরজাহান মহাব্বতের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন । ফলে তিনিও বিদ্রোহী হন । এই সংকটের ফলে কান্দাহার মুঘলের হস্তচ্যুত হয় এবং অভিজাতদের মধ্যে নূরজাহানের প্রতি বিরূপতা বৃদ্ধি পায় । ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর মারা গেলে সংকট ঘনীভূত হয় । শাহরিয়রকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি শেষরক্ষার একটা চেষ্টা করেন , কিন্তু ব্যর্থ হন । বাকি জীবন গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হন ।

ঐতিহাসিক নূরুল হাসান একটি প্রবন্ধে নূরজাহান চক্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । তাঁর মতে , নূরজাহান ও শাহজাহানের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ছিল স্পষ্ট । তাই উভয়ের মধ্যে রাজনৈতিক যোগ গড়ে ওঠা ছিল অবাস্তব কল্পনা । তা ছাড়া নূরজাহানের কর্তৃত্ব কালে এমন অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন — যাঁরা কোনোভাবেই উল্লিখিত চারজনের সঙ্গে সম্পর্কিত নন , কিংবা তাদের বিরোধী ছিলেন । ড. হাসান মনে করেন , জাহাঙ্গীরের আমলে ক্ষমতার কেন্দ্রে নূরজাহানের উত্থান যে নতুন রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি করেছিল , তার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ রাজনৈতিক চক্রের কল্পনা করেছেন । তিনি এও মনে করেন যে , জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য ভেঙে যাওয়ার কারণে পরিস্থিতির প্রয়োজনে তিনি কিছুটা রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়েছেন । ড. হাসান লিখেছেন , ১৬২০ পর্যন্ত যে – কোনো সিদ্ধান্ত , এমনকি তা নূরজাহান দ্বারা প্রভাবিত হলেও তা ছিল একান্তভাবে জাহাঙ্গীরের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ।

ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মনে করেন যে , নূরজাহানের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সাম্রাজ্যের পক্ষে শুভ হয়নি । তার নারীসুলভ আত্মাভিমান এবং ক্ষমতার প্রতি সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা সাম্রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট করেছিল । তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন , কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতা অনুধাবনের মতো কুটনৈতিক জ্ঞান তার ছিল না । তার ব্যক্তিত্ব ছিল , কিন্তু ধৈর্য ছিল না , জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকারী হিসাবে শাহজাহান ছিলেন দক্ষ , কর্মঠ , জনপ্রিয় এবং সম্রাটের প্রতি অনুগত । অথচ তিনি যে শাহরিয়ারকে পরবর্তী সম্রাট হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন , তাকে লোকে ব্যঙ্গ করে নাসুদানি বা অকর্মণ্য বলতেন , তার অদূরদর্শিতার ফলেই শাহ্জাহান বা মহাব্বত খাঁ’র নির্ভরযোগ্য মানুষেরা বিদ্রোহী হয়েছিলেন । তাই ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন , “ জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল প্রশাসনের ব্যর্থতার দায় সমানভাবে নূরজাহানেরও প্রাপ্য । ”

কিন্তু R. P Tripati ভিন্ন মত পোষণ করেন । তার মতে , নূরজাহান ক্ষমতালোভী বা ষড়যন্ত্রী ছিলেন না , সম্রাটের অক্ষমতা ও অভিজাতদের উচ্চ আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রশাসন পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন । তাঁর মতে , জাহাঙ্গীরের প্রতি নূরজাহানের প্রভাব ছিল বহুলাংশে— “ নৈতিক আবেগপ্রসূত মানসিক এবং সম্ভবত বৌদ্ধিকা । ’ তিনি লিখেন , “ খুর্রম বা মহাব্বত খাঁ’র বিদ্রোহ কিংবা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধে নূরজাহানের দায়িত্বের কাহিনি অলীক কল্পনা ও উপকথা মাত্র । ” সমকালীন প্রশাসনের উপর তার নেতৃত্বের ইতিবাচক প্রভাব প্রসঙ্গে ড. ত্রিপাঠি লিখেছেন : “ Far from being an civil genius hovering over Jahangir she was his guardian Angel . ( “ জাহাঙ্গীরের জীবনে নূরজাহানকে কোনো অশুভ শক্তি না বলে ‘ রক্ষাকারী দেবদূত ‘ বলা যুক্তিসংগত ” । )

error: Content is protected !!