ইতিহাস

আবুল ফজল কে ছিলেন

আবুল ফজল কে ছিলেন

ভারতে মুঘল যুগে ইতিহাস চর্চার কাজে সাহিত্যজাত উপাদানের অবদান উল্লেখযোগ্য । সুলতানি আমল থেকে ইতিহাস চর্চার যে ধারণা সূচিত হয়েছিল , মুঘল যুগে তা অনেকটাই পরিশীলিত ও পরিণত রূপ পেয়েছিল । মুঘল যুগে ইতিহাসমূলক সাহিত্যের রচনাকারী হিসাবে বদায়ুনী , আবদুল হামিদ লাহোরী , কাফি খাঁ , আবুল ফজল প্রমুখ অনেকের নাম স্মরণীয় । এমনকি মুঘল সম্রাট বাবর , জাহাঙ্গীর প্রমুখ , শাহাজাদী গুলবদন বেগম সহ অনেক রাজপরিবারের সদস্য ও আমলা ইতিহাসমূলক সাহিত্য রচনার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন । তবে মুঘল যুগের ইতিহাসকার হিসাবে আবুল ফজল আল্লামির নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় ।

আবুল ফজল ( ১৫৫১-১৬০২ খ্রিঃ ) ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান । তার পিতা শেখ মুবারক ছিলেন সেকালের একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও উদারপন্থী সুফি সাধক । আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ফৈজী ছিলেন একজন স্বনামধন্য কবি । বাল্যকাল থেকেই আবুল ফজল বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিভার পরিচয় দেন । মাত্র ১৫ বছর বয়সে নানা শাস্ত্রে তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন । তবে তার পরিবার মহাদেবী মতবাদের প্রতি অনুরক্ত ও শিয়াপন্থী হওয়ার কারণে গোড়াপন্থীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন । অত্যাচারিত ও নির্যাতিত তার পরিবারের প্রভাব আবুল ফজলের চিন্তা ও মননের উপর গভীর রেখাপাত করেছিল । শেষ পর্যন্ত ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুবারক মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে আশ্রয় পেলে আবুল ফজল তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পান । তার পাণ্ডিত্য ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ আকবর আবুল ফজলকে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেন ।

সম্রাটের নির্দেশে তিনি সমকালীন রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পুস্তক রচনার কাজ শুরু করেন । তার প্রখ্যাত দুটি গ্রন্থ ‘ আকবরনামা ‘ এবং  ‘ আইন ই আকবরী ‘ দুটি গ্রন্থই তিনটি করে খণ্ডে বিভক্ত । আকবরনামার প্রথম খণ্ডে তৈমুর লঙ -এর সময় থেকে হুমায়ুনের আমল পর্যন্ত মুঘল রাজ পরিবারের কাহিনি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড আকবর -এর রাজত্বকালে নানা ঘটনায় ভরা । বস্তুত আকবরের শাসনকালীন ভারতের ইতিহাস জানার জন্য , দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের মূল্য অপরিসীম । এখানে লেখক ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি সেগুলির পশ্চাৎপট ও সম্ভাব্য ফলাফলের বিষয়গুলিতে বিশ্লেষণ করেছেন । আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তিনি ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন । 

 পরবর্তী তিন বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে এই গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণতা দেন এনায়েত উল্লাহ যা ‘ তকমিল আকবরনামা ‘ নামে পরিচিত । আইন   আকবরী গ্রন্থে তিনি আকবরের আমলের বিভিন্ন সরকার আইনকানুন ও বিষয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করেছেন । আবুল ফজলের অন্য দুটি গ্রন্থ হল— ( ১ ) রোকায়ৎ আবুল ফজল ও ( ২ ) ইনসা আবুল ফজল । গ্রন্থ দুটি সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রের অনবদ্য সংকলন । প্রথম গ্রন্থে বিভিন্ন রাজপরিবারের সদস্য ও সদস্যাদের কাছে লিখিত আবুল ফজলের পত্রগুলি স্থান পেয়েছে । দ্বিতীয় গ্রন্থটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত । প্রথম খণ্ডে আছে দেশে , বিদেশে লেখা আকবরের গুরুত্বপূর্ণ পত্রগুলি । দ্বিতীয় অংশে আবুল ফজলের অবশিষ্ট পত্রগুলি সংকলিত আছে । বস্তুত সকল পত্রই সমকালীন ঘটনাবলী , নীতি ও আদর্শের উপর আলোকপাত করে । তাই এদের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম ।

আকবরনামার দ্বিতীয় খণ্ডে আবুল ফজল ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন । পূর্বসূরিদের ইতিহাস রচনা পদ্ধতি সমালোচনা করে তিনি বলেছেন যে , ইতিহাস রচনার লক্ষ্য কেবল মুসলিমদের ভারত জয়ের গৌরব কিংবা পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাফল্যের কাহিনি তুলে ধরা হয় । তার মতে , এই ধরনের ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতা তথা ইতিহাসের পক্ষে ক্ষতিকারক । তার কাছে ইতিহাস হল জ্ঞানদীপ্তির উৎস । ইতিহাসের বিষয়বস্তু যুক্তিবাদের উপর ভিত্তি করে মানুষের দুঃখ বেদনাকে জয় করতে পারলেই তার স্বার্থকতা উপলব্ধি হয় । আবুল ফজল ইতিহাস রচনার পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন যে , ইতিহাসের বিষয়বস্তু সংগ্রহের ক্ষেত্রে উপাদানের যৌক্তিকতা ভালোভাবে যাচাই করা আবশ্যিক । কারণ যুক্তি ও তথ্য বিবর্জিত কোনো রচনাকে গল্পকথা বলা যায় , প্রকৃত ইতিহাস নয় । তার মতে , ইতিহাসকে ধর্মশাস্ত্রের অঙ্গ করা সঠিক নয় । এই ক্ষেত্রে বদায়ুনীর সাথে আবুল ফজলের ইতিহাস দর্শনের মৌলিক প্রভেদ দেখা যায় । আবুল ফজল মনে করতেন যে , দর্শনশাস্ত্রের সাথে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং এরা পরস্পরের পরিপূরক । K. M. MUNSI লিখেছেন : আবুল ফজলের ইতিহাসচর্চার ভিত্তি হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদ ।

মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে একমাত্র আবুল ফজল বহুমাত্রিক ইতিহাস রচনা পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছেন । তিনি একটিমাত্র উপাদান থেকে তথ্য নিয়ে ইতিহাস রচনার পরিবর্তে সম্ভাব্য একাধিক উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এবং বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করে ইতিহাস রচনার পক্ষপাতী ছিলেন । ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন । এর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি নির্দেশনামা , প্রতিবেদন , স্মারকলিপি ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন । তার কাছে সমকালীন ইতিহাস নিছক হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্ব ছিল না । তিনি এই সংঘাতকে ঐক্যগামী শক্তির সাথে বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলির লড়াই বলে তুলে ধরেছেন । আল বিরুনির পরবর্তীকালে আবুল ফজলই প্রথম অত্যন্ত স্বহৃদয়তার সাথে হিন্দুদের ধর্ম , দর্শন ও আচার অনুষ্ঠানের গভীরতা , অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন । তার কাছে ভারতীয় মুঘল সাম্রাজ্য কোনো জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মের কর্তৃত্বের ক্ষেত্র বা প্রকাশ ছিল না । মুঘল সাম্রাজ্য ছিল জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভারতীয়দের রাষ্ট্র ।

তবে আবুল ফজলের রচনা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল না । তিনি পরিশ্রম করে আকবরের শাসনকালের বহু খুঁটিনাটি তথ্য সরবরাহ করেছেন । কিন্তু বর্ণনা দেওয়ার সময় বস্তুগত চিত্র আবেগপ্রবণতা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়েছে । তিনি আকবরের রাজত্বকালের একটি আদর্শ চিত্র তুলে ধরেছেন , বাস্তব চিত্র নয় । আকবরের দুর্বল সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে আবুল ফজল সচেতনভাবে নীরব থেকেছেন । যেমন জায়গির জমি খালিসায় পরিবর্তন করে তিনি ক্রোড়ীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন । কিন্তু এই পরীক্ষা সফল হয়নি । আবুল ফজল এই বিষয়ে নীরব থেকেছেন । আকবরের ধর্মচেতনা বা দীন ই ইলাহি প্রসঙ্গে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি । তাই অনেকেই আবুল ফজলকে রোমান্টিক বা মননধর্মী লেখক বলেছেন । জিয়াউদ্দিন বারাণী বা ফিরিস্তার মতো বস্তুবাদী ইতিহাস রচনায় তিনি কিছুটা উদাসীন ছিলেন ।

আকবরের প্রতি গভীর আস্থা তার ইতিহাসবোধকে অনেকটাই আবেগমুখী করেছিল । অবশ্য কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আবুল ফজল ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী ইতিহাসটির প্রবর্তক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন । বহুমাত্রিক সমালোচনামূলক ইতিহাস রচনা করে তিনি ইতিহাস চর্চাকে বিশিষ্টতা দিয়েছেন । তাই কিছুটা সাবধানতার সাথে গ্রহণ করলে তার রচনা থেকে সমকালীন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভবপর ।

error: Content is protected !!