ভারতে আর্যদের আগমন
Contents
ভারতে আর্যদের আগমন
আর্যদের আদি নিবাস -এর মত তাদের ভারতে আগমনকাল সম্পর্কেও কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ সাধ্য হয়নি । কারণ এই বিষয়ে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য আজও আবিষ্কৃত হয়নি । আর্যদের আগমনকাল নির্ধারণ করতে গেলে প্রথমেই স্থির করা দরকার আর্যদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদ কোন্ সময় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।
বিখ্যাত জার্মানী পণ্ডিত ম্যাক্সমূলার ‘ পশ্চাদ্বাভিমুখী গণনা ‘ বা ‘ ডেটরেকনিং ব্যাকওয়ার্ড ‘ পদ্ধতির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে , ঋকবেদের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে এবং সবশেষে হয়েছে উপনিষদ । এর সাথে বৌদ্ধধর্মের আদি রূপের অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় । তাঁর মতে, ১০৮ টি উপনিষদ সম্পূর্ণ করতে কমপক্ষে ২০০ বছর সময় লাগতে পারে এবং তা হলে , ঋকবেদের শেষাংশ রচিত হয়েছে সম্ভবত ৫০০ বছর পূর্বে । এখন বুদ্ধের জন্ম-সন যদি চীনা মত অনুসারে ৫৬৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হয় , তা হলে ঋকবেদ রচিত হয়েছে ৫৬৭ + ৫০০ = ১০৬৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ বা ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ।
বোঘাজ কোই ও তেল-এল-আর্মান এ আবিষ্কৃত শিলালিপিগুলি উপরিলিখিত মতকে সমর্থন করে । ঐ শিলালিপিতে তৎকালীন দুই রাজার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির সাক্ষী হিসেবে ইন্দ্র , মিত্র , বরুণ , নাসত্য প্রভৃতি দেবতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে । এইসব দেবতা বৈদিক আর্যদের দেবতা ছিলেন এবং ঋকবেদে এদের উল্লেখ আছে । এই ঘটনা প্রমাণ করে খ্রীঃপূঃ ১৪০০ অব্দে অর্থাৎ যখনই ঐ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই সময়ে ঋকবেদ বিন্যস্ত হয়েছিল এবং যদি ধরে নেওয়া যায় ঋকবেদ প্রথমে প্রচারিত হয় এবং পরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল , তা হলে খ্রীঃপূঃ ১৪০০ থেকে ১০০০ অব্দে তার বিন্যাস ঘটেছিল । এই সিদ্ধান্ত খুব অযৌক্তিক নয় । যাই হোক , এই বিষয়টি এখনো গবেষণার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে ।
সপ্তসিন্ধু
অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে , আর্যরা অভিভাসনের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করে এবং অনার্যদের সাথে লড়াই করে ভারতের নানা স্থানে বসতি স্থাপন করে । ভারতে প্রবেশ করে আর্যরা আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সপ্তসিন্ধু প্রথম বসতি স্থাপন করে । ঋগ্বেদে ‘ সপ্তসিন্ধু ‘ এবং আফগানিস্তানের কয়েকটি স্থান ও নদনদীর নাম পাওয়া যায় । যেমন — কুভা ( কাবুল ) , ক্ৰমু ( কুররম্ ) , গোমতী ( গোমাল ) প্রভৃতি । এখানে লক্ষণীয় যে , গঙ্গা , যমুনা বা নর্মদা নদীর উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই ; হিমালয়ের উল্লেখ আছে , তবে বিন্ধ্যপর্বতের উল্লেখ নেই । এই ভৌগোলিক বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে , আর্যরা ভারতে এসে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই প্রথম বসবাস শুরু করেছিল ।
অভ্যন্তরীণ বিবাদ
উইলি ডুরান্ট বলেছেন , ‘ আর্যরা অধিবাসী হিসেবেই ভারতে প্রবেশ করেছিল , আক্রমণকারী হিসেবে নয় । যাই হোক , লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যখন পাঞ্জাবে স্থান সঙ্কুলান অসম্ভব হয়ে ওঠে , তখন তারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়াতে শুরু করে । তা ছাড়া , পশুপালনের উপযুক্ত তৃণভূমিও তাদের ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল । কারণ এটি ছিল তাদের অন্যতম প্রধান জীবিকা । নদীর জল ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার নিয়েও আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়েছিল । ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে বা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল ।
অনার্যদের সাথে যুদ্ধ
আর্যরা ছিল যোদ্ধার জাত । তাদের সাথে ছিল উন্নত ধাতুর তৈরি বিভিন্ন অস্ত্রাদি । তাই এদেশে প্রবেশ করলে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে আর্যদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে । এদেশের লোকেদের আর্যরা বলত ‘ দস্যু ‘ । বৈদিক সাহিত্যে ‘ দাস ’ ও ‘ দস্যু’দের বিরুদ্ধে আর্যদের অভিযানের উল্লেখ আছে । আর্যরা এদেশের অধিবাসীদের সহজেই পরাজিত করতে পেরেছিল । তা ছাড়া , আর্যরা নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও দীর্ঘকাল লিপ্ত ছিল ।
দশ রাজার যুদ্ধ
এদেশে আর্যদের গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ‘ ভরত ’ ছিল প্রধান । ‘ ভরত ’ – গোষ্ঠীতে আর্যদের সাথে বহু অনার্য মিশে গিয়েছিল । ফলে আর্যদের মধ্যে ‘ বিশুদ্ধ-আর্য ’ ও ‘ আর্য-অনার্য সংমিশ্রণ ’ — এই দুটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল । দ্বন্দ্বটা ছিল মূলত এই দুই শ্রেণীর মধ্যে । ঋগ্বেদে দশ রাজার যুদ্ধের উল্লেখ আছে । সম্ভবত ভরতরাজের সাথে বিশুদ্ধ আর্যদের বাকী দশটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই যুদ্ধ হয়েছিল । এই যুদ্ধে ভরত এর নেতা সুদাসের জয়লাভও গুরুত্বপূর্ণ । কারণ সুদাস কর্তৃক রাজ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার ফলে আর্য-অনার্য মিশ্রিত গোষ্ঠীর প্রাধান্য সূচিত হয় । পাঞ্জাব অঞ্চলে আর্য বসতি ছিল বিশুদ্ধ আর্যবসতি । কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে আর্যবসতি বিস্তারে চরিত্র ছিল মিশ্র ।
পূর্ব ভারতে বসতি
ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগে আর্যরা গঙ্গা পার হয়ে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয় । ‘ শতপথ ব্রাহ্মণে ’ এর উল্লেখ আছে । আনুমানিক ১০০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে পূর্ব ভারতে আর্যবসতি বিস্তৃত হয় । এই যুগে আর্যরা পশুপালনের সাথে কৃষিকার্যও শুরু করে । পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যরা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা অঞ্চলে বসবাস বিস্তার করে । তারপর গঙ্গা ও যমুনা নদীর উপত্যকা পেরিয়ে আর্যরা অযোধ্যার সরযূ নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয় । এই সময়ে তারা পাঞ্জাবের সরস্বতী নদীর তীর থেকে এলাহাবাদ -এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল । এই অঞ্চল তখন মধ্যপ্রদেশ নামে পরিচিত ছিল ।
প্রাচী দেশ
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পূর্বাঞ্চলের মান ছিল প্রাচী । পূর্ব ভারতের ব্যাঘ্রসঙ্কুল বাংলাদেশে আর্যরা সহজে প্রবেশ করেনি । ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এই অঞ্চলকে ‘ অনার্য দস্যুদের আবাসস্থল ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে । বৌধায়নের ‘ ধর্মসূত্রে ’ ও বঙ্গদেশকে আর্যদের আবাসের অযোগ্য স্থান বলে বিধান দেওয়া হয় । পরবর্তীকালে মহাভারতের যুগে বাংলায় আর্য বসতি বিস্তারের কথা পাওয়া যায় ।
পশ্চিম ভারতে বসতি
মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমে অবস্থিত মালব , সৌরাষ্ট্র , গুজরাট প্রভৃতি সম্পর্কে প্রথম দিকের বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায় যে , এ অঞ্চলে আর্যীকরণ সহজ ছিল না । কিন্তু পরবর্তী পশ্চিম ভারতে বসতি বৈদিক সাহিত্যে পশ্চিম-ভারতকে ‘ আর্যাবর্ত ’ অর্থাৎ আর্যদের বাসস্থান বলে অনুমান করা হয়েছে । এর থেকে অনুমান করা যায় যে , পরবর্তীকালে পশ্চিম-ভারতে আর্য-বসতি স্থাপিত হয়েছিল । দক্ষিণ ভারতে আর্যবসতি বিস্তার লাভ করেছিল অনেক দেরিতে । অগস্ত্য মুনির কিংবদন্তী অনুসারে অনেকে মনে করেন যে , ঋষি অগস্ত্য বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণে আর্যবসতি স্থাপনে প্রথম অগ্রসর হয়েছিলেন । তবে দক্ষিণ ভারতে আর্য সভ্যতার পাশাপাশি দ্রাবিড় সভ্যতার প্রাধান্যের কথা জানা যায় । এখানে শবর , পুলিন্দ , অন্ত্র প্রভৃতি জাতির প্রাধান্য এখনও বিস্তর । তাই এই অঞ্চলে আর্য সভ্যতার বিস্তার হলেও তা অনেক বিলম্বে হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা ।