আর্যদের আদি বাসস্থান
আর্যদের আদি বাসস্থান
সিন্ধু সভ্যতার পতনের পরে ভারতে যে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল , তার আয়োজক ছিল নর্ডিক বা আর্যরা । নৃতত্ত্বের বিচারে নর্ডিকদের বৈশিষ্ট্য হল তাদের দীর্ঘ দেহ , উন্নত নাসা , দীর্ঘ মুণ্ড , লম্বা মুখ , প্রশস্ত ললাট ও শক্ত চিবুক । কিন্তু আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল তা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন । প্রাথমিক তথ্যের স্বল্পতাহেতু এক-একজন ঐতিহাসিক নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্যের অবতারণা করেছেন ।
বাসভূমি নির্ধারণের প্রথম শর্ত হল ‘ আর্য ‘ শব্দটির ব্যবহারিক অর্থ । খাটি সংস্কৃত অর্থ অনুযায়ী ‘ আর্য ‘ শব্দের অর্থ হল সৎবংশজাত ব্যক্তি । আবার ইউরোপীয় পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার , স্যার উইলিয়ম জোন্স প্রমুখের মতে , আর্য হল একটি ভাষার নাম । ‘ আর্য ’ শব্দটি কোন জাতিবাচক নয় । ১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিতে দেখান যে , সংস্কৃত , গ্রীক , রোমান , পারসিক প্রভৃতি ভাষাগুলির জননী এক ও অভিন্ন ভাষা । এই ভাষাকে তিনি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন । সংস্কৃত শব্দ ‘ পিতর ’ ও ‘ মাতর ’ , ল্যাটিন শব্দ ‘ পেটার ’ ও ‘ মেটার ’ , গ্রীকশব্দ ‘ পেটির ’ ও ‘ মিটির ’ এবং ইংরেজী শব্দ ‘ ফাদার ’ ও ‘ মাদার ’ ইত্যাদির গভীর সাদৃশ্য বর্তমান । সব ভাষাতেই শব্দ দুটির অর্থ বাবা ও মা । ভাষাগত এই সাদৃশ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে , এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আর্য ভাষাভাষীদের পূর্বপুরুষরা এক সাধারণ ( Common ) বাসভূমিতে বসবাস করতেন । এবং সেখান থেকে তারা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ।
ভারতীয় তত্ত্ব
একদল পণ্ডিত মনে করেন ভারতবর্ষই আর্যদের আদি বাসভূমি । এই মতের প্রধান প্রবক্তা এস. ই. পাৰ্জিটার । তার মতে পুরাণে এমন কোন তথ্য নেই যা থেকে বলা যায় যে , আর্যরা বাইরের কোন দেশ থেকে ভারতে এসেছিল । পণ্ডিত গঙ্গানাথ ঝাঁ , ড. ত্রিবেদী , ড. এ. সি. দাস প্রমুখ এই মতের সমর্থক । ঋগ্বেদে উল্লিখিত ‘ সপ্তসিন্ধুর ‘ অনুসরণে তাদের বিশ্বাস পাঞ্জাব অঞ্চলের সপ্তসিন্ধু অঞ্চল ছিল তাদের আদি বাসস্থান । এঁদের মতের সমর্থনে বলা হয় যে ,
( ১ ) ঋগ্বেদে উল্লিখিত গাছ ও পশু-পাখির সাথে এই অঞ্চলের গাছ ও পশু পাখির প্রভূত মিল পরিলক্ষিত হয় ।
( ২ ) কোন জাতি দেশ ত্যাগ করে নতুন সভ্যতা গড়ে তুললে সাধারণত অতীত গৌরবের কথা সর্বদা স্মরণ করে । কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে সপ্তসিন্ধু ছাড়া অন্য কোন দেশের নাম পাওয়া যায় না ।
( ৩ ) সংস্কৃত ভাষার মধ্যে আর্যভাষাগোষ্ঠির শব্দই সর্বাধিক বিদ্যমান ।
( ৪ ) ভারতের বাইরে আর্যভাষার চিহ্ন পরিলক্ষিত হওয়ার কারণ আর্যদের একটি গোষ্ঠী ভারত হয়ে পশ্চিম এশিয়া ও অন্যান্য স্থানে গমন করে তারা আর্যজাতির অংশ বিশেষ , মূলশাখা নয় ।
( ৫ ) আর্যদের যাগযজ্ঞ ভিত্তিক ধর্মানুষ্ঠান একমাত্র ভারতবর্ষেই দেখা যায় । বিপক্ষে যুক্তি :
স্যার জন মার্শাল প্রমুখ ভারতীয় তত্ত্বের যুক্তিগুলি খণ্ডন করেছেন । এঁদের যুক্তি হল—
( ১ ) ভারতবর্ষই যদি আর্যদের আদি বাসভূমি হয় , তাহলে তারা নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম সারা দেশকে আর্য-সংস্কৃতিভুক্ত করার চেষ্টা করে থাকবে । তারপরেই বহির্ভারতে সংস্কৃতি বিস্তার করবে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় , দক্ষিণ ভারতে অনার্য ভাষা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল । এমনকি , আর্যদের প্রধান কেন্দ্র উত্তর ভারতেরও কোন কোন স্থানে এখনও অনার্য ভাষা প্রচলিত আছে । ড. আর. সি. মজুমদারের মতে , এই ঘটনাই প্রমাণ করে ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল না ।
( ২ ) প্রাক্ ঐতিহাসিক সিন্ধু-সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার থেকে অনেক উন্নত এবং স্বতন্ত্র ছিল । এই সভ্যতা উত্তর- পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল । যদি আর্যরা প্রথম থেকে ঐ অঞ্চলে থাকত , তা হলে তাদের সাহিত্যে নিশ্চয়ই সিন্ধু- সভ্যতার উল্লেখ থাকত , কিন্তু তা নেই । এমনকি পূর্ব-ইউরোপের লিথুয়ানিয়ার ভাষার সঙ্গে আর্যভাষার ঘনিষ্ঠতা দেখা যায় ।
( ৩ ) ইউরোপে গ্ৰীক , ল্যাটিন , জার্মান প্রভৃতি আর্যভাষাগুলির যেরূপ ঘনসন্নিবেশ দেখা যায় , ভারতে তা দেখা যায় না । যেহেতু ইউরোপে আর্যভাষাগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি , তাই পণ্ডিতদের ধারণা ইউরোপেই আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল ।
বহির্ভারতীয় তত্ত্ব
আর্যদের বাসভূমি নির্দিষ্ট করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ নিজ নিজ গবেষণার ভিত্তিতে একাধিক স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন । সেরগী জাবরোওস্কির মতে , উত্তর আফ্রিকা ছিল আর্যদের আদি নিবাস । আবার ঐতিহাসিক হার্ট -এর মত হল যে , আর্যরা ইউরোপ হতে ককেশাস পর্বত পার হয়ে ইরানে প্রবেশ করে । সেখান থেকে ভারতে আসে । অধ্যাপক গাইলস -এর মতে , দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল । পেকা এবং রাইস – এর মতে , ক্সাণ্ডিনেভিয়াতে ছিল আর্গদেৱ আদি বসতি । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘ দ্য আরক্টিক, হোম অব দি এরিয়ানস ‘ গ্রন্থে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে , উত্তর মেরু অঞ্চলে আর্যরা আগে বসবাস করত । তিলক বৈদিক সাহিত্য উল্লেখ করে বলেছেন , সেখানে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি ছিল । একমাত্র উত্তর মেরুতেই তা সম্ভব । তিনি মেরু অঞ্চলের গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধির কথাও উল্লেখ করেছেন । অবশ্য আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ মেরু অঞ্চলের প্রবল শৈত্যপ্রবাহের কথা স্মরণ করে তিলকের বক্তব্যকে আজগুবি বলে অভিহিত করেছেন । তবে ভূ-তত্ত্ববিদরা বলেন , মেরু অঞ্চল একদা মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল ।
আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে ম্যাক্সমুলার , জ্যাকব প্রমুখের ‘ মধ্য এশিয়া তত্ত্ব ‘ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এদের মতে , আর্যদের আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়া । পরে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ পথ ধরে এশিয়া মাইনরের মধ্য দিয়ে তাদের একটি শাখা গ্রীস ও ইতালিতে উপস্থিত হয় , অপর একটি শাখা পশ্চিমের পথ ধরে উপস্থিত হয় ভারতবর্ষে । এই তত্ত্বের সমর্থনে বলা হয়েছে , পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দা আবেস্তায় উল্লিখিত ‘ আরিয়ানাভেজা ‘ নামক স্থানটি মধ্য-এশিয়ায় অবস্থিত এবং এখানেই প্রথম মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল । ব্যাবিলনে আবিষ্কৃত খ্রীঃপূঃ ২১০০ অব্দের একটি প্রস্তরফলকে ঘোড়াকে পূর্বদিক থেকে আগত গাধা বলে বর্ণনা করা হয়েছে । এই ঘটনা প্রমাণ করে , ঐ অঞ্চলের লোকের কাছে ঘোড়া অজানা ছিল এবং এই ফলকে আর্যদের আগমনের কথাই বলা হয়েছে ।
অধ্যাপক ব্র্যাণ্ডেনস্টাইনের বক্তব্যতেও উপরিলিখিত তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া যায় । তার মতে , আর্যদের প্রথম দিকের ব্যবহৃত শব্দে এমন কোন শব্দ ছিল না যাতে জলাশয় বা গাছপালার ইঙ্গিত ছিল । মধ্য-এশিয়ার কিরঘিজিয়া তৃণভূমি অঞ্চলের জলাশয় বা গাছপালার অস্তিত্ব ছিল না । তাই ধরা যেতে পারে , আর্যরা ঐ অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে । আর্যদের আদি নিবাস সম্পর্কে মধ্য-এশিয়া তত্ত্বে অধিকাংশ পণ্ডিতের সমর্থন থাকলেও কিন্তু সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় । কারণ মধ্য-এশিয়ার নিষ্পাদপ তৃণভূমি অঞ্চলে আর্যদের মত বিশাল গোষ্ঠীর বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল । অবশ্য আধুনিক আবহাওয়াবিদদের মতে , সম্প্রতি বৃষ্টিপাতের স্বল্পতাহেতু মধ্য-এশিয়া জীবনযাপনের অযোগ্য হলেও তিন-চার হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ বসবাসের উপযোগী ছিল না , একথা বলা যায় না । তাই অধিকাংশের মত আর্যরা সম্ভবত মধ্য-এশিয়া থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল ।