মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে
Contents
মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে

যে প্রক্রিয়ায় একটি ডিপ্লয়েড দেহকোশ বিভাজিত হয়ে সম আকৃতির , সমগুণ সম্পন্ন ও সম সংখ্যক ক্রোমোজোম বিশিষ্ট দুটি ডিপ্লয়েড অপত্য কোশ সৃষ্টি করে তাকে মাইটোসিস ( Mitosis ) বলে । বিজ্ঞানী ওয়ালটার ফ্লেমিং ( Walter Flemming ) 1878 খ্রিস্টাব্দে প্রথম মাইটোসিস প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও নামকরণ করেন ।
মাইটোসিসের স্থান
আদর্শ নিউক্লিয়াস যুক্ত দেহকোশে মাইটোসিস ঘটে । উদ্ভিদের ক্ষেত্রে কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাগে , ভ্রূণমূল , ভ্রূণমুকুল প্রভৃতির ভাজক কলায় এবং প্রাণীদের ক্ষেত্রে ভ্রূণের পরিস্ফুরণ ও বৃদ্ধিকালে দেহকোশে মাইটোসিস ঘটে ।
কোন কোন কোশে মাইটোসিস ঘটে না
পরিণত নার্ভকোশ ও লোহিত কণিকায় মাইটোসিস ঘটে না ।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের বিভিন্ন দশা
ক্যারিওকাইনেসিস
বিভাজন শুরু হওয়ার পূর্বে কোশের নিউক্লিয়াসটি স্থির থাকে । কোশের এই অবস্থাকে ইন্টারফেজ ( Interphase ) বলে । ইন্টারফেজ G1 , S ও G2 , এই তিন দশায় বিভক্ত । ইন্টারফেজে DNA , RNA ও প্রোটিন ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে কোন কোশ মাইটোসিস প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত হয় । মাইটোসিস প্রক্রিয়াটি প্রোফেজ , মেটাফেজ , অ্যানাফেজ এবং টেলোফেজ দশার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ।
প্রোফেজ :
প্রোফেজ ( Prophase ; গ্রিক Pro = প্রথম , Phase = দশা ) হলো মাইটোসিসের প্রথম এবং দীর্ঘস্থায়ী দশা । এই দশায় নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি ঘটে—
( 1 ) নিউক্লিয়াস থেকে জল অপসারিত হয় , ফলে ক্রোমোজোমগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যায় ।
( 2 ) নিউক্লীয় জালিকার তন্তুগুলির নিজস্ব জট ক্রমশ খুলে যায় , ফলে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক সুতোর ন্যায় লম্বাকৃতি ক্রোমোজোম পরিলক্ষিত হয় ।
( 3 ) প্রতিটি ক্রোমোজোম লম্বালম্বি দ্বি-বিভক্ত হয়ে একজোড়া করে ক্রোমাটিড ( Chromatid ) গঠন করে । ক্রোমাটিড দুটি সেন্ট্রোমিয়ার অঞ্চলে যুক্ত থাকে ।
( 4 ) ক্রোমাটিডগুলি ক্রমশ স্প্রিং -এর মতো প্যাঁচাতে থাকে , ফলে ক্রোমোজোমগুলি আকারে ছোটো ও মোটা হয় । একে স্পাইরালাইজেশান ( Spiralization ) বলে ।
( 5 ) এই দশার শেষের দিকে নিউক্লিওলাস ও নিউক্লীয় পর্দা বিলুপ্ত হয় ।
( 6 ) প্রাণীকোশের ক্ষেত্রে , সেন্ট্রোজোমগুলি বিপরীত মেরুর দিকে অগ্রসর হয় এবং দুটি সেন্ট্রোজোমের মধ্যস্থলে সাইটোপ্লাজমীয় অনুনালিকা ও প্রোটিন সহযোগে বেমতন্তুর আবির্ভাব ঘটে ।
( 7 ) উদ্ভিদকোশে সেন্ট্রোজোম না থাকায় কোশের নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম হতে বেম বা স্পিণ্ডল গঠনের সূত্রপাত হয় ।
মেটাফেজ :
মেটাফেজ ( Metaphase ; Meta = মধ্যবর্তী , Phase = দশা ) হলো মাইটোসিসের দ্বিতীয় দশা এবং ইহা স্বল্পস্থায়ী । এই দশায় নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি ঘটে—
( 1 ) এই দশায় স্পিণ্ডল -এর গঠন সম্পূর্ণ হয় । মাকুর ন্যায় স্পিণ্ডল -এর উভয় প্রান্তের সরু অংশ দুটি মেরু অঞ্চলে পরিণত হয় ।
( 2 ) ক্রোমোজোমগুলি স্পিণ্ডল -এর মধ্যরেখায় নিরক্ষীয় তলে পাশাপাশি সজ্জিত হয় ।
( 3 ) স্পিণ্ডল -এর কতকগুলি তন্তু ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ারের সহিত যুক্ত হয় এবং বাকি তন্তুগুলি সরাসরি এক মেরু হতে অন্য মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে সেন্ট্রোমিয়ারের সহিত সংযুক্ত তন্তুকে ক্রোমোজোমাল তন্তু এবং এক মেরু হতে অন্য মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত তন্তুকে অবিচ্ছিন্ন তন্তু বলে ।
( 4 ) এই দশায় ক্রোমোজোমগুলি সর্বাপেক্ষা সংকুচিত হওয়ায় এগুলি সর্বাপেক্ষা মোটা ও ছোটো আকারের হয় । তাই ক্রোমোজোমের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় ।
অ্যানাফেজ :
অ্যানাফেজ ( Anaphase ; Ana পশ্চাৎ , Phase = দশা ) হলো মাইটোসিসের তৃতীয় দশা ও সর্বাপেক্ষা স্বল্পস্থায়ী । এই দশায় নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি ঘটে —
( 1 ) এই দশার প্রারম্ভে সেন্ট্রোমিয়ারের বিভাজন ঘটে , ফলে প্রতিটি ক্রোমোজোমের ক্রোমাটিড দুটি পরস্পর পৃথক হয় । এক্ষেত্রে প্রতিটি ক্রোমাটিডকে অপত্য ক্রোমোজোম বলে ।
( 2 ) এই দশার শেষের দিকে প্রধানত ক্রোমোজোমাল তন্তুর সংকোচনের ফলে অপত্য ক্রোমোজোমগুলি নিরক্ষীয় অঞ্চল হতে পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে মেরু প্রান্তের দিকে অগ্রসর হয় । অপত্য ক্রোমোজোম দুটির মধ্যাঞ্চলে ইন্টারজোনাল তন্তুর আবির্ভাব হয় এবং এগুলি প্রলম্বিত হয়ে অপত্য ক্রোমোজোমকে মেরু অভিমুখে চালিত করে ।
টেলোফেজ :
টেলোফেজ ( Telophase ; Telo = প্রান্তীয় , Phase = দশা ) হলো মাইটোসিসের শেষ দশা । এই দশায় নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি ঘটে—
( 1 ) অপত্য ক্রোমোজোমগুলি দুই মেরুতে পৌছায় এবং বেমতন্তুর বিলুপ্তি ঘটে ।
( 2 ) কোনো একটি ক্রোমোজোমের নিউক্লিওলার অর্গানাইজার অংশ হতে নিউক্লিওলাসের পুনরায় আবির্ভাব ঘটে । নিউক্লীয় পর্দা পুনরায় গঠিত হয় ।
( 3 ) ক্রোমোজোমগুলি স্প্রিং -এর মতো পাক খুলে সূক্ষ্ম , দীর্ঘ ও সরু তন্তুতে পরিবর্তিত হয় এবং নিউক্লীয় জালিকা গঠন করে পূর্ণাঙ্গ নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে ।
( 4 ) এই অবস্থায় নিউক্লিয়াস জল শোষণ করে সম্পৃক্ত হয় , ফলে ক্রোমোজোমগুলিকে দেখা যায় না ।
( 5 ) অপত্য ক্রোমোজোমগুলি মাতৃকোশের ক্রোমোজোমগুলির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আকার ফিরে পায় এবং একটি নিউক্লিয়াস হতে দুটি নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হয় ।
সাইটোকাইনেসিস
কোশবিভাজনের যে দশায় কোশের সাইটোপ্লাজম সমান দুইভাগে বিভক্ত হওয়ায় কোশবিভাজনের সমাপ্তি ঘটে এবং দুটো অপত্যকোশ উৎপন্ন হয় , তাকে সাইটোকাইনেসিস বলে । টেলোফেজ দশার শুরুতেই সাইটোকাইনেসিস শুরু হয় এবং এই দশার সমাপ্তির সঙ্গেই সাইটোকাইনেসিস শেষ হয় । উদ্ভিদ কোশের ক্ষেত্রে ফ্র্যাগমোপ্লাস্ট গঠনের মাধ্যমে সাইটোপ্লাজমের বিভাজন হয় ।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের বৈশিষ্ট্য
মাইটোসিস বিভাজনে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়—
( i ) মাইটোসিস পদ্ধতিতে জীবের দেহ কোশ বিভাজিত হয় ।
( ii ) মাতৃকোশের নিউক্লিয়াস , ক্রোমোজোম এবং সাইটোপ্লাজম এই পদ্ধতিতে মাত্র একবার বিভাজিত হয় ।
( iii ) এই প্রকার কোশবিভাজনে মাতৃকোশ থেকে দুটি অপত্যকোশের সৃষ্টি হয় ।
( iv ) অপত্যকোশের ক্রোমোজোম মাতৃকোশের ক্রোমোজোমের সমসংখ্যক ও সমগুণ সম্পন্ন হয় ।
( v ) অপত্যকোশের নিউক্লিয়াস মাতৃকোশের নিউক্লিয়াসের মত সমগুণ ও সমআকৃতি বিশিষ্ট হয় ।
মাইটোসিস কোষ বিভাজনের তাৎপর্য
জীবদেহে মাইটোসিস এর প্রধান তাৎপর্য গুলি হল—
( i ) মাইটোটিস কোষবিভাজন প্রক্রিয়ায় দেহকোশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবের সামগ্রিক বৃদ্ধি ঘটে ।
( ii ) মাইটোটিস কোশবিভাজন কোশে DNA এবং RNA- র আনুপাতিক পরিমাণের সমতা বজায় রাখে ।
( ii ) জিন ক্রোমোজোমে রৈখিক সজ্জায় বিন্যস্ত থাকায় এবং ক্রোমোজোমগুলি লম্বালম্বিভাবে বিভাজিত হওয়ায় মাতৃকোশ থেকে সৃষ্ট দুটি অপত্যকোশে ক্রোমোজোম তথা জিনের সমবণ্টন ঘটে ফলে জীবদেহের কার্যকারিতা এবং বৃদ্ধি সুশৃঙ্খল হয় ।
( iv ) বহুকোশি জীবের ক্ষেত্রে এককোশি জাইগোট বা ভ্রূণাণু থেকে মাইটোটিস কোশবিভাজনের মাধ্যমে পরিণত জীবের সৃষ্টি হয় ।
( v ) মাইটোসিস কোশবিভাজনের মাধ্যমে এককোশী উদ্ভিদ ও প্রাণী বংশবিস্তার করে ।
( vi ) মাইটোসিস কোশবিভাজনের মাধ্যমে জীবদেহের ক্ষয়িষ্ণু এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহকোশের প্রতিস্থাপন হয় ।