বসুন্ধরা সম্মেলন
বসুন্ধরা সম্মেলন

মানব সমাজ সর্বদাই উন্নতিকামী । বিগত বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ( বিশেষত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ) অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় , খাদ্য , বাসস্থান , বস্ত্র এবং স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়ােজনীয় রসদের সরবরাহে টান পড়েছে । এই বিপর্যয় থেকে মানুষ অব্যাহতি পেয়েছে কারণ বিংশ শতাব্দীতেই মানুষ কৃষি , শিল্প এবং প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নতি করেছে । এই সকল ক্ষেত্রে উন্নতি করতে গিয়ে মানুষের হাতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ । পরিবেশে দূষণের মাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে বিগত শতাব্দীতে । প্রকৃতিকে শােষণ করার ফলে দূষিত হয়েছে বায়ু , জল , মাটিসহ মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপাদান ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , মধ্য ইউরােপ , গ্রেট ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে 1960 – এর গােড়ার দিকে বৃষ্টিতে অতিমাত্রায় আম্লিক মান সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে দূষণ সম্বন্ধে সচেতন করে তােলে । পরীক্ষা – নিরীক্ষা করে বােঝা যায় বৃষ্টির জলের আম্লিকতার জন্য দায়ী শিল্পের বর্জ্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানির বেহিসাবি দহন ।
এই ঘটনার পরে পরেই সমগ্র ইউরােপ , আমেরিকা , তৎকালীন সােভিয়েত রাশিয়ায় বিভিন্ন সংগঠন তৈরি হয় ; যারা পরিবেশের সুরক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করে । ক্রমে ক্রমে এশিয়া , দক্ষিণ আমেরিকাতেও পরিবেশের সুরক্ষার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে চেতনার উন্মেষ হয় । এদের মিলিত উদ্যোগেই সম্মিলিত রাষ্ট্রসংঘের একটি সাধারণ সভা সুইডেনের স্টকহােমে ( Stockholm in Sweden ) 1972 খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় । সভার বিষয়বস্তু ছিল মানুষের পরিবেশ ( Human environment ) । এই সভার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে । এরই ফলশ্রুতি হিসাবে 1982 খ্রিস্টাব্দে কেনিয়ার নাইরােবিতে ( Nairobi in Kenya ) পরিবেশ নিয়ে দ্বিতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলন থেকেই বহমান উন্নয়ন ( sustainable development ) বিষয়ে একটি ধারণা চালু হয় ।
এই সম্মেলন থেকে জানা যায় যে 1972 খ্রিস্টাব্দে স্টকহোম সম্মেলন যেখানে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির উপর বেশি জোর দিয়েছিল সেখানে 1982 – র নাইরােবি সম্মেলন বেশি গুরুত্ব দেয় বায়ু এবং জল দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপরে । সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের উপর । তৈরি হয় বহমান উন্নয়ন তত্ত্ব , যা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বজায় রেখে একই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার দিকে জোর দেবার অঙ্গীকার নেওয়া হয় ।
এই সম্মেলনের ফলে সমগ্র বিশ্ব দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায় । একটি অংশে থাকে বিশ্বের ধনশালী দেশগুলি , যাদের বলা হয় উন্নত দেশ ( Developed countries , DC ) এবং অন্যদিকে থাকে কম উন্নত ( Less Developed Countries , LDC ) । উন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা কম , সম্পদ বেশি , শিল্পে উন্নত , মানুষের মাথা পিছু আয় অনুন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি । অপরদিকে অনুন্নত দেশগুলির জনসংখ্যা বেশি , প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও তা সুষ্ঠু ব্যবহারের উপযােগী প্রযুক্তির খুবই অভাব । তবে এসব দেশে লােকদের চাহিদা কম নয় । এই সকল কারণে পৃথিবী যখন দ্বিধাবিভক্ত তখন , সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা 1983 খ্রিস্টাব্দে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে । এই প্রস্তাব অনুসারে গঠিত হয় পরিবেশ এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্ব কমিশন ( World Commission on Environment and Development , WCED ) । এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল বহমান উন্নয়নের পর্যালােচনা করা । এই কমিশন কতকগুলি বিশেষ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলে । যেমন—
( 1 ) প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জনসংখ্যার প্রভাব । এতে আছে—
( ক ) খাদ্যের নিরাপত্তা — অর্থাৎ যেখানে প্রয়ােজন সেখানেই খাদ্যের জোগান সুনিশ্চত করতে হবে ।
( খ ) জৈব বৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটি ( biodiversity ) — উদ্ভিদ এবং প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে ।
( গ ) শক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং শক্তি সংরক্ষণ ।
( 2 ) শিল্পে পরিবেশের ক্ষতিকারক বস্তুর ব্যবহার কমাতে হবে ।
( 3 ) নগরায়ণের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি করে তা রূপায়ণ করতে হবে । এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে আলােচ্যসূচিতে রেখে পরিবেশ নিয়ে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের তৃতীয় বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় 1992 খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও ( Rio – de – Janerio , Brazil ) তে । এই সম্মেলনের জনপ্রিয় নাম হল বসুন্ধরা সম্মেলন বা আর্থ সামিট ( Earth summit ) । বসুন্ধরা সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বহমান কৃষিজ উৎপাদন , পরিবেশ সহায়ক প্রযুক্তি , বহমান শক্তির ব্যবহার ( sustainable energy use ) এবং বহমান শিল্প উৎপাদন ( sustainable industrial activity ) । বিশেষত বহমান শিল্প উৎপাদন নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা এবং সমালােচনার পরে একটি কার্যকরী কর্মসূচি ( Action Programme ) 21 নম্বর এজেন্ডা ( Agenda – 21 ) তৈরি হয় । এতে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয় ।
বসুন্ধরা সম্মেলনের ( The United Nations Conference on Environment and Development , UNCED ) 21 নম্বর এজেন্ডায় ( agenda ) বলা হয় প্রতিটি দেশ পরিবেশ সুরক্ষায় তাদের দেশের পরিস্থিতি বিচার করে বিশেষ আইন প্রণয়ন করবে । এই আইনের মাধ্যমে বহমান উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ এবং তার আগমনের ব্যবস্থা থাকবে । এজেন্ডা -21 বহমান উন্নয়নের পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠনের কথা বলে । এই কমিটির নাম হবে Commission on Sustainable Development ( COSD ) ।
এই বসুন্ধরা সম্মেলনের পরবর্তী ধাপে আসে ওজোন স্তরের ক্ষয় হবার মতাে আশঙ্কা । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1994 -এ এককভাবে ওজোন স্তরের ক্ষতিকারক গ্যাস ক্লোরােফ্লুরাে কার্বনের ( CFC ) ব্যবহার 1996 সালের মধ্যে বন্ধ করবার প্রস্তাব দেয় । যদিও সেই প্রস্তাব সর্বাংশে কার্যকরী হয়নি তথাপি বসুন্ধরা সম্মেলন পৃথিবীর মানবতাকে রক্ষা করার যে প্রতিশ্রুতি তৈরি করেছে তার প্রতি সকল বিশ্ববাসীর সমর্থন এবং সহযােগিতা থাকা একান্ত জরুরি ।