শব্দ দূষণ কাকে বলে
Contents
শব্দ দূষণ কাকে বলে
কোনাে বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে 20 বারের বেশি কিংবা 20,000 বারের কম কম্পিত হয় তাহলে একপ্রকারের শব্দ সৃষ্টি হয় । বস্তুর কম্পনের ফলে পরিবৃত বাতাসের যে পর্যায়ক্রমিক ঘনীভবন ( compression ) ও তনুভবন ( refraction ) ঘটে , তা চতুর্দিকে বিস্তৃত হলে যে তরঙ্গ গতির ( wave motion ) সৃষ্টি হয় , তাকেই শব্দ তরঙ্গ ( sound wave ) বলে । এই শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দাতে আঘাত করলে আমাদের সেই শব্দের শ্রবণানুভূতি হয় । প্রত্যেক শব্দ অন্য শব্দ থেকে তিনটি ব্যাপারে পৃথক হয়ে থাকে , যথা — শব্দের তীব্রতা ( loudness ) ( কর্কশ বা কোমল ) , তীক্ষ্ণতা ( pitch ) ( উঁচু বা নীচু ) এবং স্বর ( note ) ( শব্দের বিশিষ্টতা ) । শব্দের তীব্রতা শব্দ তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ( বিস্তারের ) ( amplitude ) উপর নির্ভর করে । শব্দের তীক্ষ্ণতা শব্দতরঙ্গের দুতির উপর নির্ভর করে ।
শব্দ তরঙ্গের বিস্তার সমান হলে সেই শব্দ শ্রুতি মধুর হয়ে থাকে । শব্দ তরঙ্গের বিস্তার ও শ্রুতির পার্থক্যে শব্দ কর্কশ হয়ে ওঠে । এই কর্কশ শব্দের সঙ্গে আমাদের কান অপরিচিত হলে শব্দ অসহ্য লাগে । আবার কিছুদিন একই শব্দ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে আমাদের শ্রুতি স্নায়ুতে পরিবর্তন ঘটে । এই পরিবর্তন স্থায়ী হলে কোমল স্বর আর শুতিগােচর হবে না । ফলে আংশিক বধিরতা সৃষ্টি হবে । এই বৈশিষ্ট্য অভিযােজনিক বৈশিষ্ট্য । শব্দের প্রভাবে জীবের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় বলে একে ‘ শব্দদূষণ ’ বলা হয় । শব্দদূষণ নাগরিক সভ্যতার অভিশাপ স্বরূপ । শব্দের তীব্রতা মাপার একককে ডেসিবেল বলে ।
শব্দ দূষণের কারণ
শব্দ দূষণের বিভিন্ন কারণ হতে পারে । সব শব্দই শব্দ কিন্তু শব্দের পার্থক্য পরিবেশের পার্থক্যের জন্য আলাদা হয়ে থাকে , ফলে ব্যক্তির উপর তার প্রভাবও পৃথক হয় ।
শিল্পাঞ্চলের শব্দ দূষণ :
কলকারখানা সংলগ্ন স্থানে যাদের বাস তারা সাধারণত কারখানায় কাজ চলাকালীন অবস্থায় ব্যক্তির শ্রবণানুভূতি যতটা থাকে কয়েক বছর কাজ করবার পর তা কমে যায় । তখন জোরে কথা না বললে সেই ব্যক্তি শুনতে পায় না । একেই ‘ আংশিক বধিরতা’ বলে । কারখানায় কর্মরত অবস্থায় মেশিনের শব্দ ব্যক্তির শ্রুতি স্নায়ুর সংবেদনশীলতা আংশিক নষ্ট করে দেয় । কলকারখানার শব্দ মানুষের মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করে ।
শহরের পরিবেশ শব্দ দূষণ :
শহরে যাদের বাস বড়াে রাস্তার উপরে , তাদের শ্রুতিস্নায়ু দিবারাত্র বাস , ট্রাম এবং বিভিন্ন যানবাহনের বিকট শব্দের প্রভাবে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে থাকে । এই সব ব্যক্তি প্রথম প্রথম স্বাভাবিক থাকে , কিন্তু ক্রমশ তাদের নানারকমের স্নায়বিক ব্যাধি দেখা দেয় — এইসব রােগের মধ্যে অনিদ্রা , খিদে না হওয়া , খিটখিটে মেজাজ , হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতাজনিত রােগ অন্যতম । বড়াে রাস্তার ধারে বসবাসকারী ব্যক্তির সঙ্গে গলিতে বসবাসকারী ব্যক্তির তুলনামূলক পরীক্ষায় এইসব রােগ ধরা পড়ে ।
শহরের বাস ড্রাইভারদের মধ্যে ( কর্কশ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজাবার জন্য ) আংশিক বধিরতা রােগ এবং নানাবিধ স্নায়বিক রােগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ।
রেডিও লাউড স্পিকার প্রভৃতি দোকানের কর্মচারীদের মধ্যেও নানাবিধ স্নায়বিক দৌর্বল্য দেখা যায় ।
প্রেসের মেশিন চালকদের একঘেয়ে ঘটাংঘটাং শব্দ তাদের স্নায়বিক উত্তেজনা , উচ্চ রক্তচাপ , বিষণ্ণতা , অনিদ্রা , মাথাধরা প্রভৃতি রােগের কারণ ।
স্টেশনের পরিবেশে শব্দ দূষণ :
শহরের বড়াে বড়াে রেল স্টেশনের কোলাহলমুখর স্থানে কাজ করে এমন ব্যক্তির স্বভাবের পরিবর্তন ঘটে । এরা উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত হয় , কারণ নিজেরা উচ্চস্বর ছাড়া কোনাে কিছুই শুনতে পায় না ।
বিমানবন্দরের শব্দ দূষণ :
বিমানবন্দরের কাছ যাদের বাস তারা বিমানের ওঠা নামাকালীন বিমানের বিকট শব্দের সঙ্গে ক্রমে পরিচিত হয়ে উঠে । বিমান ওঠা নামাকালীন বিমানবন্দরের সংলগ্ন বাড়িগুলিতে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তা বসবাসকারী ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে । এইসব স্থানের ব্যক্তিদের নানাবিধ স্নায়বিক রােগ দেখা দেয় । অনেকক্ষেত্রে এটি গর্ভবতী স্ত্রীলােকদের গর্ভস্থ সন্তানের মানসিকতাকে প্রভাবিত করে ।
শেয়ার বাজারের শব্দ দূষণ :
শহরের শেয়ার বাজারে যে সব ব্যবসায়ী সর্বদা থাকেন তাদের সর্বদাই উচ্চকণ্ঠে কথাবার্তা বলতে হয় , ফলে শেয়ার বাজারের পরিবেশ সর্বদাই কোলাহলপূর্ণ থাকে । দীর্ঘদিন এরূপ পরিবেশে থাকার ফলে এরা পরিবেশের সঙ্গে অভিযােজিত হয়ে পড়ে ; তার ফলে এদের মানসিক স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায় । এরা স্বরযন্ত্রের বিভিন্ন রােগ , স্নায়বিক বৈকল্য , বিমর্ষতা , অনিদ্রা প্রভৃতি রােগের শিকার হয়ে পড়ে ।
শব্দ দূষণের ফলাফল
শব্দের তীব্রতা ( intensity ) মাপার একককে ডেসিবেল ( decibel ) বলে । বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেল -এর নামানুসারে 0.1 বেলকে ( bel ) 1 ডেসিবেল ( decibel , dB ) বলা হয় ।
ডেসিবেল ( dB ) = 10 log ✖ ( নির্ণীত শব্দের তীব্রতা ( intensity of sound ) ➗ প্রমাণ শব্দের তীব্রতা ( intensity of standard sound )
0 থেকে 140 ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দের যে কোন মাত্রাই কানের ক্ষতি করতে পারে । এর মধ্যে 70-140 dB সব থেকে বেশি ক্ষতিকর । পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্টের রায় অনুসারে মানুষের শ্রুতিগ্রাহক শব্দের সর্বোচ্চ মান 65 dB ধরা হয়েছে । শব্দদূষণের ফলে মানুষের 一
( i ) কর্ণপটহ ছিড়ে যেতে পারে , ( ii ) সম্পূর্ণ বধির হতে পারে , ( iii ) হৃদযন্ত্রের গােলযােগ হতে পারে । অস্বাভাবিক হৃৎছন্দ , হৃৎপিণ্ডের গতি হ্রাস পাওয়া প্রভৃতি ঘটনা দেখা যায় । ( iv ) শ্বসন হার হ্রাস পায় । ( v ) লালাগ্রন্থি এবং পাকস্থলির ক্ষরণ হ্রাস পায় ।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করতে হবে 一
( i ) কলকারখানায় শব্দ নিরােধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
( ii ) কলকারখানার সন্নিকটে বসতি স্থাপন বন্ধ করা এবং ঘন বসতিপূর্ণ স্থানের নিকটে কলকারখানা স্থাপন নিষিদ্ধ করা ।
( iii ) শহরে গাড়ি যাতে অযথা হন না বাজায় তা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা ।
( iv ) শহরের যানবাহনের নির্দিষ্ট পথে যাতায়াতকালীন যথাসম্ভব শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা ।
( v ) শহরে যাতে উচ্চস্বরে রেডিও কিংবা মাইক বাজানাে বন্ধ হয় তার জন্য আইন করা ।
( vi ) বিমানবন্দরের নিকটে যাতে বসতি স্থাপন না হয় তার প্রতি লক্ষ রাখা ।
( vii ) প্রতিটি নাগরিক যাতে তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকে সেরূপ শিক্ষা প্রদান করা ।
( viii ) রেডিও , টেলিভিশন , সংবাদপত্র প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় শব্দদূষণের মারাত্মক কুফল সম্বন্ধে জনসাধারণকে সজাগ করে তােলা । এ বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের মিলিত প্রয়াস কাম্য ।
শব্দের বিভিন্ন উৎস এবং তা থেকে উৎপন্ন শব্দের তীব্রতা ( ডেসিবেল dB একক )
শব্দের উৎস | ডেসিবেল ( dB ) একক |
1. রেডিওর স্বাভাবিক শব্দ | 45 dB |
2. রেডিওর উচ্চস্বরের শব্দ | 70 dB |
3. পটকা বাজির শব্দ | 90-120 dB |
4. লাউড স্পিকারের শব্দ | 110-115 dB |
5. জেট প্লেন ওড়ার শুরুকালীন শব্দ ( Jet plane take off sound ) | 150 dB |
6. মোটর গাড়ির স্টিরিও ( car stereo ) | 130 dB |
7. ডিস্কোথেক ( discotheque ) | 120 dB |
৪. ভারি যন্ত্রের শব্দ ( heavy machine sound ) | 100 dB |
9. সাবওয়ে ট্রেন , ভারি ট্রাফিক ( subway train , heavy traffic ) | 90 dB |
10. শহরের ট্রাফ্রিক ( city traffic ) | 70 dB |
11. নরম সুরে কথাবার্তা ( subdued conversation ) | 60 dB |
12. ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ | 20 dB |