জীবন বিজ্ঞান

ডারউইনের তত্ত্ব

Contents

ডারউইনের তত্ত্ব

images1
ডারউইনের তত্ত্ব

চার্লস রবার্ট ডারউইন ( Charles Robert Darwin ) 1809 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন । তার ঠাকুরদাদা ইরাসমাস ডারউইনের ( Erasmus Darwin ) মদতে 1831 খ্রিস্টাব্দে তিনি H. M. S. Beagle নামে একটি গবেষণা জাহাজে শিক্ষানবিশ হিসাবে সমুদ্র যাত্রায় গমন করেন । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে প্রচুর নমুনা ( specimens ) সংগ্রহ করে 1835 খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন । 

এরপর দীর্ঘদিন গবেষণার পরে 1858 খ্রিস্টাব্দে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের ( Alfred Russel Wallace ) সঙ্গে যৌথভাবে জৈব বিবর্তন সম্বন্ধে গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন । পরের বছর 1859 খ্রিস্টাব্দে তার বিখ্যাত ‘ দি অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন ‘ ( The origin of species by means of natural selection ) প্রকাশিত হয় । এই পুস্তকে তিনি তার যুগান্তকারী প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ প্রকাশ করেন । ডারউইনের মতবাদ ডারউইনিজম নামে বিখ্যাত । মতবাদটি নিম্নলিখিত তথ্য এবং সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত :

অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি 

সকল জীবই তাদের আপন বংশরক্ষা এবং বিস্তারের জন্য অত্যধিক সংখ্যায় অপত্য বা বংশধর সৃষ্টি করে । একে জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধি বলা হয় । যেমন — একটি স্ত্রী স্যালমন মাছ জনন ঋতুতে প্রায় তিন কোটি ডিম পাড়ে । স্তন্যপায়ীদের মধ্যে হাতির প্রজনন সংখ্যা খুবই কম । যে হাতি 11-12 বছরে একটি সন্তান প্রসব করে সেই এক জোড়া হাতির বংশধর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থেকে ওই হারে সন্তান উৎপাদন করলে 750 বছরে পৃথিবীতে হাতির সংখ্যা হত এক কোটি নব্বই লক্ষ । 

খাদ্য ও সীমিত বাসস্থান

ভূপৃষ্ঠের আয়তন সীমাবদ্ধ হওয়ায় খাদ্য এবং বাসস্থান সীমিত থাকে । ফলে জীবদের সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে খাদ্য এবং বাসস্থানের জন্য জীবদের মধ্যে সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী । ডারউইন এই সংগ্রামের নাম দিয়েছেন অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম ( struggle for existence ) । 

অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম 

ডারউইন মনে করেন খাদ্য এবং বাসস্থানের তুলনায় জনসংখ্যার পরিমাণ অনেক বেশি হলে একই প্রকার খাদ্য এবং বাসস্থানের জন্য জীবদের মধ্যে সংগ্রাম হতে বাধ্য । তিনি বলেন , যে সকল জীব অতিমাত্রায় অপত্য সৃষ্টি করে তারাও পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাতেই আছে । এর কারণ যত জীব সৃষ্টি হবার কথা তত সংখ্যায় তারা বেঁচে থাকে না । তাই ডারউইন জীবদের সংগ্রামকে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন । ডারউইনের মতে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম তিন প্রকার । যেমন— ( ক ) অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম ( Intraspecies struggle ) , ( খ ) আন্তর প্রজাতি সংগ্রাম ( Interspecies struggle ) এবং ( গ ) প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ( Struggle against unfavourable environment ) ।

অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম : এই সংগ্রাম কেবলমাত্র একই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে ঘটে থাকে । যেমন — একটি হরিণের জন্য চারটি বাঘের মধ্যে প্রতিযােগিতা । 

আন্তর প্রজাতি সংগ্রাম : এই সংগ্রাম একই প্রকার খাদ্য এবং বাসস্থানের উপর নির্ভরশীল একাধিক প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে ঘটে থাকে । যেমন — সুন্দরবনের একাধিক মাংসাশী প্রাণীরা তৃণভােজী হরিণের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে । হরিণের অভাব হলে আন্তর প্রজাতি সংগ্রামের জন্য মাংসাশী প্রাণীদের সংখ্যাও কমে যাবে । 

প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম : মুক্ত পরিবেশে বসবাসকারী সকল জীবকেই নানাবিধ প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন — বন্যা , খরা , ভূমিকম্প , অগ্ন্যুৎপাত প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা প্রচণ্ড ঠান্ডা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় । জীবন সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল জীবই কেন বেঁচে থাকতে পারে না তার কারণ হিসাবে ডারউইন বলেন যে , এদের মধ্যে নানাপ্রকার ভেদ বা প্রকরণ ( variation ) আছে । তাই সকলে সমানভাবে উপযুক্ত হয় না । 

ভেদ বা প্রকরণ 

ডারউইনের মতে একই খাদ্য এবং বাসস্থানের জন্য দাবিদার একই প্রজাতির বিভিন্ন জীব এবং ভিন্ন প্রজাতির জীবদের মধ্যে সকল গুণ সমানভাবে থাকে না । একে তিনি ভেদ বা প্রকরণ ( Variation ) বলে চিহ্নিত করেছেন । যেহেতু সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের যােগ্যতা সমান থাকে না তাই সংগ্রামরত জীবদের মধ্যে সামান্য সংখ্যকই বেঁচে থাকে । 

যোগ্যতমের উদবর্তন

ডারউইন মনে করেন , সংগ্রামরত জীবদের মধ্যে প্রকরণগত পার্থক্য থাকায় একদল বিজয়ী হয় এবং অপরদল পরাজিত হয়ে থাকে । যারা বিজয়ী হয় তাদের প্রকরণগুলি নির্দিষ্ট পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ থাকে । যারা পরাজিত হয় তারা অন্য কোনাে পরিবেশে বিজয়ী হতেও পারে । কাজেই ভালাে প্রকরণ যুক্ত জীবেরাই একটি পরিবেশে যােগ্যতম হিসাবে বেঁচে থাকে । ডারউইন একে যোগ্যতমের উদবর্তন বলেন ।

প্রাকৃতিক নির্বাচন 

ডারউইনের মধ্যে ভালাে প্রকরণ যুক্ত জীবেরা সংগ্রামে বিশেষ সুবিধা পেলেও সংগ্রামে কে বিজয়ী হবে এবং পরিবেশের সঙ্গে সঠিক ভাবে অভিযােজিত হয়ে বংশগতি বজায় রাখতে পারবে তা প্রকৃতিই নির্বাচন করে দেয় । একে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন । ডারউইন এর “ অরিজিন অব স্পিসিস ” নামক পুস্তকে “ প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি ” প্রকাশ করেন । তত্ত্বটির সারমর্ম হল –

যেহেতু কোনাে প্রাণী যত সংখ্যায় বেঁচে থাকে তা অপেক্ষা অনেক বেশি সংখ্যায় অপত্যের জন্ম দিয়ে থাকে । যেহেতু ক্রমাগত জীবন সংগ্রাম অব্যাহত আছে এটা থেকে ধারণা জন্মায় যেকোনাে প্রকরণ যা অন্য প্রাণীর এবং পরিবেশের তুলনায় বেশি লাভজনক তা হলে প্রজাতির ওই প্রাণী বেঁচে থাকবার সুযােগ বেশি পায় এবং স্বভাবতই প্রাকৃতিক নির্বাচন লাভ করে । প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রাপ্ত প্রাণীর নির্বাচিত প্রকরণ বংশগতি লাভ করে । 

নতুন প্রজাতির সৃষ্টি 

ভালাে প্রকরণযুক্ত জীব প্রাকৃতিক নির্বাচন পেয়ে পরিবেশের সঙ্গে অভিযােজিত হয়ে ক্রমাগত বংশবিস্তার করতে থাকে । এভাবে তাদের বংশধরদের মধ্যে নতুন নতুন প্রকরণ পুঞ্জীভূত হয় । ফলে নতুন প্রজন্মের জীবদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষের প্রকরণগত পার্থক্য সৃষ্টি হয় । নতুন প্রকরণ সমৃদ্ধ বংশধর এক সময়ে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে এতটাই বৈসাদৃশ্য হয় যে তাদের একটি নতুন প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা যায় । এইভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে । 

error: Content is protected !!