সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র
Contents
সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র

পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন একটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য বায়ােস্ফিয়ার রিজার্ভ ( Biosphere reserve ) । বহু সংখ্যক নদী এই বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে । সমুদ্রের জোয়ার-ভাটায় প্রতিদিনই এই বনাঞ্চলে বিধৌত হয় । এই নদী মােহনা অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ ভেজিটেশনের ( mangrove vegetation ) গুরুত্ব সর্বাধিক । এদের শাখা প্রশাখা যুক্ত মূল মাটিকে আঁকড়ে ধরে ভূমিক্ষয় থেকে মােহানাকে রক্ষা করে । এখানে নদীতে আছে নানাপ্রকার মাছ , চিংড়ি সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী জলজ প্রাণী । এদের সাথে আছে কুমিরের মতাে সংরক্ষিত প্রাণী । তেমনি বনে আছে নানাপ্রকার স্থলপ্রাণী এবং এদের সঙ্গে রয়েছে বিশেষ উল্লেখযােগ্য সংরক্ষিত স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার ।
সুন্দরবনের অবস্থান
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার দক্ষিণ প্রান্তে বহুসংখ্যক নদীনালা বিধৌত বিশাল বনাঞ্চল সুন্দরবন নামে পরিচিত । সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নদীগুলি প্রবাহিত হয়ে সমগ্র বনভূমিকে বহুসংখ্যক দ্বীপমালায় বিভাজিত করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে । বঙ্গোপসাগরের জোয়ার ভাটার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে । সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের স্বভাব এবং বাসস্থানের উপরে । সুন্দরবনের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের অন্তর্গত । সমগ্র সুন্দরবনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের নিয়ে একপ্রকার বিশেষ জৈব বৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে । ফলে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় ( world heritage list ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । সুন্দরবনকে বায়ােস্ফিয়ার রিজার্ভ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
সুন্দরবনের আয়তন
সমগ্র সুন্দরবনের মােট আয়তন প্রায় সাড়ে নয় হাজার কিলােমিটার । এর মধ্যে ভারতীয় সুন্দরবনের আড়াই হাজার কিলােমিটার ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত এবং দেড় হাজার কিলােমিটার বনভূমি অঞ্চল । বনাঞ্চলটির পশ্চিমদিক মাতলা নদী এবং পূর্বদিকে হরিণঘাটা নদীদ্বারা সীমাবদ্ধ ।
সুন্দরবনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য
সুন্দরবন নামটির সঙ্গে সুন্দরী নামে একটি গাছের সম্পর্ক জড়িত হলেও এই বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ পাওয়া যায় । সুন্দরবনের বিশেষ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ম্যানগ্রোভ নামে পরিচিত । বৈজ্ঞানিক পরিভাষা অনুসারে সমুদ্র তীরবর্তী নদীর মােহনা এবং বদ্বীপ অঞ্চলে লবণাক্ত মাটিতে অবস্থিত যে বনভূমি সমুদ্রের জোয়ারে প্রতিদিন প্লাবিত হয় সেই বনভূমিকে বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ বলে । সুন্দরবনের অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে আছে গরান , বোড়া , সুন্দরী , কেওড়া , হারগােজা , গােলপাতা প্রভৃতি ।
সুন্দরবনের উদ্ভিদদের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । এখানকার মাটি লবণাক্ত । গাছগুলি জোয়ারের জলে বিধৌত হলেও মাটিতে লবণের আধিক্য থাকায় এবং অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় এই মাটিকে শারীরবৃত্তীয় শুষ্ক মৃত্তিকা বলা হয় । এই পরিবেশে অভিযােজনের জন্য এখানকার উদ্ভিদ শ্বাসমূল তৈরি করে । শ্বাসমূল মাটি ভেদ করে উপর উঠে আসে । এই মূলের অগ্রভাগে বহু ছিদ্র থাকে । এই ছিদ্রের মাধ্যমে উদ্ভিদ বাতাসের অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে । শ্বাসমূল ছাড়াও সুন্দরবনের অনেক উদ্ভিদের ঠেসমূল তৈরি হয় । জোয়ার-ভাটার প্রভাবে গাছগুলি যাতে মাটি থেকে উপড়ে না যায় ঠেসমূল সেই কাজে সাহায্য করে ।
সুন্দরবনের অনেক উদ্ভিদের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম । মাটি লবণাক্ত হওয়ায় উদ্ভিদের বীজ মাটিতে পড়লে অঙ্কুরোদগমহয় না । তাই এই উদ্ভিদের বীজ গাছে থাকা অবস্থাতেই বীজের মধ্যে অঙ্কুরােদগম ঘটে । ভ্রূণের মূল শক্ত এবং সূচালাে হয় এবং পরিণত হলে বীজটি গাছ থেকে খসে নরম মাটিতে মূলটি প্রােথিত হয় । এর পরে বীজপত্র তৈরি হয় ফলে উদ্ভিদটি স্বাভাবিকভাবে বেচে থাকতে পারে ।
সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্য
সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রকার বহুপ্রকার অমেরুদণ্ডী এবং মেরুদণ্ডী প্রাণী আছে । এদের মধ্যে এককোশী প্রােটোজোয়া থেকে উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণী পর্যন্ত পাওয়া যায় । বহুকোশী অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সন্ধিপদ পর্বের অন্তর্গত ক্রাস্টাসিয়া শ্রেণিভুক্ত প্রাণীদের আধিক্য দেখা যায় । বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য । মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে একাধিক সরীসৃপ শ্রেণিভুক্ত প্রাণী পাওয়া যায় । যেমন , গােসাপ , কুমীর , কচ্ছপ , বিভিন্ন প্রকার সাপ বিশেষ উল্লেখযােগ্য । মেরুদণ্ডীদের মধ্যে নানাপ্রকার মৎস্য জাতীয় প্রাণী সুন্দরবনের সম্পদ । ইলিশ , পার্শে , ভেটকি , ভাঙ্গর প্রভৃতি বিশেষ পরিচিত মাছ । সুন্দরবনে আছে পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল । সুন্দরবনের সজনেখালিতে গড়ে উঠেছে একটি পক্ষী অভয়ারন্য ( bird sanctuary ) । এখানে পেলিক্যান , আইরিশ , সাদা এবং কালাে গলা যুক্ত বক প্রচুর পরিমাণে বাস করে ।
মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ , বাঁদর , শূকর , মেছাে বেড়াল , শেয়াল , বেজি , শুশক , ভোদর এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশেষ উল্লেখযােগ্য ।
সুন্দরবনের প্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা
সুন্দরবনের প্রাণীদের সংরক্ষণের ব্যবস্থাবলীর মধ্যে অন্যতম ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প । 119 টি ছােটো ছােটো দ্বীপ নিয়ে ব্যাঘ্র প্রকল্পটি গঠিত । এর আয়তন 2585 বর্গকিলােমিটার । এর মধ্যে 1330 বর্গকিলােমিটার বিস্তৃত অঞ্চলটি বিশেষ সংরক্ষিত অক্সল । একে ওয়াইল্ডারনেস জোন ( wilderness zone ) বলে । এর বাইরে আছে বাফার অঞ্চল ( Buffer Zone ) ।
ব্যাঘ্র প্রকল্প ছাড়া পাথরপ্রতিমার কাছে ভরতপুরে তৈরি হয় বৃহত্তম কুমির প্রকল্প । এখানকার Crocodylus porosus নামক কুমির বিশেষ উল্লেখযােগ্য । সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের উদাহরণ— সুন্দরবনের মধ্যে দুটি ভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র বর্তমান । যথা , ( i ) স্থলের বাস্তুতন্ত্র ও ( ii ) জলের বস্তুতন্ত্র ।
স্থলের বাস্তুতন্ত্র :
অজৈব উপাদান — কার্বন ডাই-অক্সাইড , অক্সিজেন , নাইট্রোজেন , মৃত্তিকায় অবস্থিত জৈব এবং অজৈব পদার্থ বিশেষত বােদ বা হিউমাস ( humus ) ।
উৎপাদক — বৃহৎ বৃক্ষ , যেমন সুন্দরী , গরাণসহ অন্যান্য বৃক্ষ যারা অরণ্যভূমিতে চাঁদোয়া ( canopy ) গঠন করে । মাঝারি বা খর্ব আকৃতির উদ্ভিদ যেমন ম্যানগ্রোভ বা হেতাল এবং বীরুৎ বা গুল্মশ্রেণির উদ্ভিদ ।
খাদক — এখানে বিভিন্ন প্রকার খাদক পাওয়া যায় । বিভিন্ন প্রকার পতঙ্গা , খরগােস , গিরগিটি , সাপ , ঈগল , বাজপাখি , শৃগাল , বন্যশূকর , বাঁদর , বাঘ সকলেই খাদক , তবে এদের খাদ্যশৃঙ্খলে পার্থক্য আছে ।
বিয়ােজক — ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ।
জলের বাস্তুতন্ত্র :
অজৈব উপাদান — জল , অক্সিজেন , কার্বন ডাইঅক্সাইড , ক্যালসিয়াম ও নাইট্রোজেন ঘটিত লবণ ইত্যাদি ।
উৎপাদক — জলে ভাসমান এবং মৃত্তিকায় আবদ্ধ বিভিন্ন উদ্ভিদ , ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ।
খাদক — জুপ্ল্যাঙ্কটন , শামুক , ঝিনুক , চিংড়ি , বিভিন্ন প্রকার মাছ যারা কেবলমাত্র উদ্ভিদ খেয়ে বেঁচে থাকে । অন্যান্য মাছ যারা ছােটো মাছদের খেয়ে বেঁচে থাকে । যেমন — সাপ , কচ্ছপ এবং কুমির । এ সমস্ত খাদকদের প্রথম , দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির খাদকে ভাগ করা যায় এবং এরা একাধিক খাদ্যশৃঙ্খলে অংশগ্রহণ করে খাদ্য তরঙ্গ ( food web ) গঠন করে ।
বিয়ােজক — ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক অন্যতম বিয়ােজক ।