বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বলতে কী বােঝায়
Contents
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বলতে কী বােঝায়
প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ , জীবজন্তু , কীটপতঙ্গ , অণুজীব ইত্যাদি জীবগােষ্ঠীর স্বাভাবিক জন্ম , বিকাশ , মৃত্যু ঘটলেও নিয়মিতভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে পুষ্টিস্তর অনুযায়ী এদের মধ্যে শক্তির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ থাকে । এর ফলে পুষ্টির প্রতিটি স্তরে জীবগােষ্ঠীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে সমান থাকে । কোনাে বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক থেকে বিয়ােজক পর্যন্ত জীবগােষ্ঠীর আনুপাতিক সংখ্যার স্থিতিশীল অবস্থাই হল বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ।
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষার শর্ত বা বৈশিষ্ট্য
বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল —
জীববৈচিত্র্য :
বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা বা ভারসাম্য অনেকটা জীববৈচিত্র্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । যে বাস্তুতন্ত্রের জীববৈচিত্র্য যত বেশি , সেই বাস্তুতন্ত্রে খাদ্যশৃঙ্খলও ততই জটিল । এক্ষেত্রে সরল খাদ্যশৃঙ্খল অপেক্ষা খাদ্যজালের উপস্থিতি বেশি মাত্রায় লক্ষ করা । যায় । এইরূপ বাস্তুতন্ত্রে বসবাসকারী প্রাণীরা বিভিন্ন উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে । তাই , পুষ্টিস্তরের একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হলে প্রাণীদের খাদ্যের তেমন ঘাটতি দেখা দেয় না । ফলে , বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষায় তেমন কোনাে বিঘ্ন ঘটে না ।
জীব সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাবকগুলির অস্তিত্ব :
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষাকারী নির্দেশকগুলির মধ্যে বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘকালীন স্থিতিশীল প্রজাতির সংখ্যা অন্যতম । অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ , পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের জোগান , প্রতিরােধ ও প্রতিযােগিতার ক্ষমতা , বংশবৃদ্ধির অবিঘ্ন হার প্রভৃতি কারণে বাস্তুতন্ত্রে জীবসংখ্যা বৃদ্ধি পায় । আবার , প্রতিকূল আবহাওয়া , প্রাকৃতিক বিপর্যয় , খাদ্যের অভাব , রােগের প্রাদুর্ভাব , প্রতিরােধ ও প্রতিযােগিতার ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি কারণে জীবসংখ্যা হ্রাস পেতে পারে । এই দুই বিপরীতধর্মী সমান ক্ষমতা সম্পন্ন প্রভাবকগুলির ক্রিয়াকলাপের ফলেই বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষিত হয় ।
ভারসাম্যে ফিরে আসার ক্ষমতা :
নানা কারণে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে । তবে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃতি তার পরিবেশে পুনরায় ভারসাম্য অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে । যে বাস্তুতন্ত্রের পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসার সামর্থ্য যত বেশি , সেই বাস্তুতন্ত্র তত বেশি সুস্থির বা স্থিতিশীল ।
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বা স্থিতিশীলতা নষ্টের কারণ
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কতকগুলি কারণ রয়েছে—
অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার :
বাস্তুতান্ত্রিক মূল্যায়ন ছাড়াই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণ ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে বাস্তুতন্ত্র তার স্থিতিশীলতা হারাচ্ছে । বাস্তুতন্ত্রে ধারাবাহিক বা শৃঙ্খলিত কার্যপ্রণালীর একটি উপাদান ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বা বাধাপ্রাপ্ত হলে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের কার্যপ্রণালী বিঘ্নিত হয় ও বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় । যেমন — মাটির রস শিকড়ের মধ্য দিয়ে পাতায় আসে । ওই জল প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাসে মুক্ত হয় এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে । নানা কারণে অতিরিক্ত অরণ্য ছেদনের ফলে বাস্তুতন্ত্রের একটি একক বাধাপ্রাপ্ত হলে পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয় ।
পরিবেশ দূষণ :
পুরােনাে ও অদক্ষ প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়ােগের ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত হচ্ছে । বায়ুমণ্ডল , শিলামণ্ডল , জলমণ্ডল ও জীবমণ্ডল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করছে ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি :
পরিবেশের অবনমনে ও দূষণে জনবিস্ফোরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বেশি ঘনবসতি অঞ্চলে সম্পদের পুনরুৎপাদনের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে বেশি পরিমাণে সম্পদ আহরণের দিকে গুরুত্ব দেওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে ।
যেখানে সেখানে বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ :
কৃষিক্ষেত্র থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থ ও পৌর প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য পদার্থগুলি সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করে পরিবেশে নিক্ষেপ করলে পরিবেশ দূষিত হয় । বর্তমানে নদীমােহানা ও খাড়িগুলি মানুষের কাছে বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপের নির্বাচিত স্থান হয়ে উঠেছে । ফলে , নদীতে নিক্ষিপ্ত পদার্থসমূহ মােহানায় সঞ্চিত হয়ে নদী ও সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করছে ।
সহযোগিতার অভাব ও প্রতিযোগিতার প্রাধান্য :
পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সহযােগিতার পরিবর্তে প্রতিযােগিতা অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে । ফলে , পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে ।
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষার উপায়
বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষার উপায় কতকগুলি উপায় অবলম্বন করলে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব । যেমন—
1. প্রকৃতি থেকে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত সম্পদের আহরণ ও ব্যবহার হ্রাস ।
2. সম্পদের পুনরুৎপাদনের ব্যবস্থা করা ।
3. গচ্ছিত সম্পদের ( Fund Resource ) পরিবর্তে বিকল্প দ্রব্যের ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব আরােপ ।
4. পুনর্ভব ও প্রবহমান সম্পদের ( Renewable and Flow Resource ) বিবেচনা প্রসূত বৈজ্ঞানিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরােপ ।
5. যথাযথ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে প্রকৃতিতে প্রত্যর্পণ ।
6. বাস্তুতান্ত্রিক ধারক ও বাহকরূপে উৎপাদকের ( সবুজ উদ্ভিদ ) রক্ষণাবেক্ষণ ও সৃজনের যথাযথ ব্যবস্থা করা ।
7. ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ সংরক্ষণ ও এর অর্থনৈতিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব প্রদান ।
8. পরিবেশে দূষকের অনুপ্রবেশ রােধে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রতিযােগিতার পরিবর্তে সহযােগিতার বাতাবরণ তৈরি করা ।
9. বাস্তুতন্ত্রের মূলনীতি সংক্রান্ত শিক্ষাদান ও প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে এর প্রয়ােজনীয়তা বােঝানাে ।