জীবন বিজ্ঞান

জীববিজ্ঞানের অবদান ও গুরুত্ব

Contents

জীববিজ্ঞানের অবদান ও গুরুত্ব

index 12
জীববিজ্ঞানের অবদান ও গুরুত্ব

জীববিজ্ঞানের অবদান ( Contribution of Biology ) 

সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম থেকে মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে জীববিদ্যার সাহায্যে প্রভাবিত হয়েছে । জীববিদ্যার মাধ্যমে মানুষ নিজের সম্বন্ধে , পারিপার্শ্বিক উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে । জীববিদ্যার বহুবিধ অবদানের কয়েকটি হচ্ছে—

খাদ্য উৎপাদন :

মানুষ সহ সব প্রাণীর অস্তিত্ব উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে আছে । আমাদের প্রয়ােজনীয় খাদ্যবস্তু যেমন — শর্করা , শ্বেতসার , চর্বি , তৈল এবং প্রােটিন — সবই আমরা উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকি । বিভিন্ন প্রাণী থেকে পাওয়া যায় প্রাণীজ প্রােটিন ।  

শস্যের রক্ষা :

জীববিজ্ঞান অধ্যয়ন করে ফসলের ক্ষতিকারক বস্তু এবং তাদের প্রতিকার ব্যবস্থা জানতে পারা যায় । 

পরিধেয় ও ব্যবহার্য বস্তু :

পরিধেয় বস্ত্র বোনার জন্য উদ্ভিজ্জ তন্তু , ঘরবাড়ি তৈরি করবার জন্য কাঠ , ওষুধের জন্য ভেষজ উদ্ভিদ , নানাধরনের রঙের কাঁচামাল — তৈল , গঁদ , রেজিন প্রভৃতি — উদ্ভিদ থেকে পাই ।

জ্বালানি :

প্রাকৃতিক তেল , কয়লা , অন্যান্য জ্বালানি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায় । 

ভেষজ :

নানা প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায় । 

কৃষিকাৰ্য :

অধিক ফলনশীল নানাবিধ শস্য জীববিদ্যা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রয়ােগ করে উৎপাদিত হয়েছে । তৈরি হয়েছে জৈব সার । এছাড়া , বন্যা ও ভূমিক্ষয় রােধে , বিনোদনে , পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে , জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন প্রকার শিল্পের কাঁচামাল জোগান দিয়ে জীববিদ্যা মানুষকে একটি উন্নত সামাজিক জীবে পরিণত করেছে । 

জীববিজ্ঞানের গুরুত্ব ( Importance of Biological Sciences in this Millennium ) 

1859 খ্রিস্টাব্দে চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জীবের উ‌‌দ্‌বর্তন তৎকালীন সমাজে জীববিদ্যা প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করেছিল । এর পরে 1866 খ্রিস্টাব্দে গ্রেগর মেন্ডেলের বংশগতি সংক্রান্ত মতবাদ 1900 খ্রিস্টাব্দে পুনঃ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জীববিদ্যার ভিত্তি দৃঢ়তর হয়েছিল । 

সমগ্র বিংশ শতাব্দী জুড়ে জীববিদ্যার গবেষণা গতি এবং প্রগতি দুটি দিকেই তাৎপর্য পূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছিল । ফলে শুধুমাত্র জীববিদ্যার নিজস্ব আঙ্গিক অর্থাৎ জীববিদ্যার পরিবারের শাখাপ্রশাখাই বৃদ্ধি পেয়েছিল তাই নয় সেসঙ্গে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে যুগ্মভাবে নতুন নতুন বিভাগের সৃষ্টি হতে লাগল । যেমন পদার্থবিদ্যার সঙ্গে জীববিদ্যার সংযােগের ফলে তৈরি হয়েছে জীব পদার্থবিদ্যা ( Biophysics ) , রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে জীব রসায়ন বা জৈব রসায়ন ( Bio-chemistry ) পরিসংখ্যান শাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে জীব পরিসংখ্যান বিদ্যা ( Biometry or Bio-statistics ) , মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে মহাকাশ জীববিদ্যা ( Space-Biology ) , জীববিদ্যা এবং ইলেকট্রনিকস্ বিদ্যার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে জীব-ইলেকট্রনিক্স ( Bio-electronics or Bionics ) ; বাস্তুবিদ্যা এবং জীববিদ্যা মিলে সৃষ্টি হয়েছে জীব-বাস্তুবিদ্যা ( Bio-engineering ) । এই বিষয়গুলির আগেই ভূগােল বিদ্যা সঙ্গে যৌথভাবে গঠিত হয়েছে ভৌগােলিক জীববিদ্যা ( Bio geography ) ; ভূবিদ্যার সঙ্গে মিশে তৈরি হয়েছে জৈব-ভূবিদ্যা ( Bio-geology ) । 

বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে 1953 খ্রিস্টাব্দে ওয়াটসন এবং ক্রিক ( J. D. Watson and E.H.C.Crick ) কর্তৃক DNA- র মডেল আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে জীববিদ্যার এবং বিশেষ একটি শাখা অণুজীববিদ্যা ( Molecular Biology ) গঠিত হয় । পরবর্তী সময়ে এই শাখা কোশ জীববিদ্যা ( Cell Biology ) এবং অণু-বংশগতি বিদ্যা ( Molecular genetics ) ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে প্রায়ােগিক জীববিদ্যা ( Applied Biology ) । 

জীববিজ্ঞানের প্রধান দুটি শাখা উদ্ভিদবিদ্যা ( Botany ) এবং প্রাণীবিদ্যার ( Zoology ) বিষয় বস্তু বেড়ে গিয়ে ওদের প্রত্যেকেরই বেশ কয়েকটি উপশাখা গঠিত হয় । এই উপশাখাগুলিকে বিশুদ্ধ উদ্ভিদ এবং প্রাণীবিদ্যা ( Pure Botany and Pure Zoology ) এবং ফলিত উদ্ভিদ এবং প্রাণীবিদ্যা ( Applied Botany and Applied Zoology ) হিসাবে বিভাজিত করা যায় । 

জীববিদ্যার ( উদ্ভিদ এবং প্রাণীবিদ্যা ) ফলিত শাখাগুলি এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিতভাবে যে সকল শাখা গঠিত হয়েছে এদের প্রত্যেকের মিলিত প্রচেষ্টার ফলে জীববিদ্যার অনেক উন্নতি হয় । পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে জীববিদ্যার বিভিন্ন শাখার জ্ঞান প্রয়ােগ করেই ভবিষ্যতের সমস্যা মেটানাে সম্ভব হবে বলে জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন । এজন্য বর্তমান শতাব্দীকে জীববিদ্যার অগ্রগতির শতক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে । আর এই অগ্রগতি বায়ােটেকনােলজির যথাযথ প্রয়ােগের ফলেই সম্ভব । তাই বর্তমান শতাব্দীকে বায়োটেকনোলজির শতাব্দী বলে ধরা হচ্ছে । 

বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি কী

বায়োটেকনোলজি হল জীব বিদ্যাচর্চায় ব্যবহৃত কতকগুলি পদ্ধতি যা নানাবিদ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন এবং বর্তমানে জৈব প্রযুক্তি হিসাবে বিভিন্ন শিল্প উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে । মােটামুটিভাবে ধরা যায় 1953 সালে ওয়াটসন এবং ক্রিক ( Watson and Crick ) দ্বারা DNA অণুর নকশা আবিষ্কারের মাধ্যমে বায়ােটেকনােলজি সূচনা হয়েছিল । 

এরপরে DNA , RNA এবং প্রােটিন সংক্রান্ত নানাপ্রকার গবেষণার দ্রুত প্রসারণ ঘটতে থাকে । হাইব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সংঘটিত ‘ সবুজ বিপ্লব ’ মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হওয়ায় জীববিদ্যার অবদান অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে এবং এর ব্যবহার অপরিহার্য বলে গৃহীত হয় । ক্রমে ক্রমে উদ্ভিদ এবং প্রাণী কোশকলা কালচার মাধ্যমে লালনপালনের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় । তৈরি হয় টিস্যু কালচার প্রযুক্তি ( tissue culture techniques ) । উদ্ভিদের মাইক্রোপ্রপাগেশন ( micro propagration ) সংক্রান্ত কাজে এবং প্রাণীদের কোশ সংক্রান্ত গবেষণায় এই প্রযুক্তি বিশেষ উপযােগী । 

কোশ সংকরায়ণ ( cell hybridization ) পদ্ধতি অনাক্রম্যতা ( immunological ) গবেষণায় ব্যাপক সাড়া জাগায় । ক্রমে আবিষ্কৃত হয় জিন ক্লোনিং ( gene cloning ) পদ্ধতি । যা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ( genetic engineering ) বা রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি ( recombinant DNA technology ) গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মােচন করেছে । এই প্রযুক্তির ফলস্বরূপ আবিস্কৃত হয়েছে DNA ফিঙ্গার প্রিন্টিং ( DNA finger printing ) ; মলিকুলার ফার্মিং ( molecular pharming ) ; ট্রান্সজেনিক জীব ( transgenic organism ) তৈরি ; জিন থেরাপি ( gene therapy ) প্রভৃতি পদ্ধতি । মানুষের খাদ্য , বস্ত্র , চিকিৎসাসহ বিভিন্ন প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্রে এইসব পদ্ধতির অবদান অবিস্মরণীয় । 

PCR পদ্ধতির আবিষ্কার জিন প্রযুক্তিতে নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করেছে । এর ফলে অতি অল্প সময়ে মানুষসহ বিভিন্ন জীবের জিনসজ্জা ( gene sequence ) জানা সম্ভব হয়েছে । হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট ( HGP ) এই কাজে সাহায্য করেছে । এখন চেষ্টা চলছে মানুষের কোন্ রােগের সঙ্গে কোন্ জিন যুক্ত তা শনাক্তকরণ । ক্ষতিকারক জিনকে সরিয়ে ভালাে জিন সংযুক্তিকরণের কাজও এগিয়ে চলেছে । মানুষের ক্ষতিগ্রস্থ কোশকলাকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য চলেছে স্টেম সেল গবেষণা ( stem cell research ) । মানুষের জিন ভান্ডার সংক্রান্ত গবেষণার ফলে তৈরি হয়েছে জিনোমিক্স ( genomics ) শাস্ত্র । তেমনি প্রােটিন সংক্রান্ত তথ্যের জন্য তৈরি হয়েছে প্রােটিওমিক্স ( proteomics ) । 

কমপিউটারের প্রয়ােগ জীব প্রযুক্তি গবেষণাকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে । বিভিন্ন গবেষণা লব্ধ তথ্য সংগ্রহ ও তাদের ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে বায়োইনফরমেটিক্স ( bioinformatics ) । সুতরাং জীববিদ্যার হাত ধরেই মানুষ আজ এক নতুন প্রযুক্তি বিশ্বে পদার্পণ করেছে । তাই বর্তমান শতক জীববিদ্যার শতক -এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নাই ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!