সবুজ বিপ্লব বলতে কী বোঝো
Contents
সবুজ বিপ্লব বলতে কী বোঝো

ভারতবর্ষে ১৯৬০ এর দশকে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার , রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ প্রয়ােগ , ট্রাক্টর , হারভেস্টর প্রভৃতি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি , ক্ষুদ্র ও মাঝারি জলসেচ প্রকল্প রূপায়ণ এবং জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল যার ফলস্বরূপ কৃষিজ ফসল উৎপাদন অত্যাধিক পরিমানে বৃদ্ধি পায়, যাকে সবুজ বিপ্লব বলা হয় । ডঃ এম. এস. স্বামীনাথান ছিলেন ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক । গম ও ধান ছিল সবুজ বিপ্লবের প্রধান ফসল । ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব প্রথম দেখা যায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে।
১৯৬৮ সালে উইলিয়াম গ্যাড সবুজ বিপ্লব শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন । সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয় উচ্চফলনশীল বীজের আবিষ্কারক নরম্যান বোরলাঙকে । স্বাধীন ভারতে কৃষির উন্নতির জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও প্রথম তিন-চারটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি-উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি । কারণ , তখন কৃষিকাজ প্রধানত প্রাচীন পদ্ধতিতে করা হত । এই অবস্থার প্রতিকারকল্পে ১৯৬০ -এর দশকের শেষের দিকে এবং ৭০ এর দশকের শুরুতে কৃষির উন্নতির জন্য কতকগুলি নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয় । নতুন ব্যবস্থার মধ্যে কৃষিতে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার , রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ প্রয়ােগ , ট্রাক্টর , হারভেস্টর প্রভৃতি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি , ক্ষুদ্র ও মাঝারি জলসেচ প্রকল্প রূপায়ণ এবং জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
এছাড়া , কৃষিজ ফসল উৎপাদনের সঙ্গে ফসলের মালিকানা স্বত্বের সংযােগসাধনেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয় । এইসব ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়ােগ করার ফলে ৬০ -এর দশকের শেষের দিকে এবং ৭০ -এর দশকে কৃষিজ ফসলের উৎপাদনও বাড়তে থাকে । কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কৃষিজ ফসল উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার এই পরিস্থিতিকে সবুজ বিপ্লব বলা হয় ।
এক ফসলি জমিকে বহু ফসলি জমিতে রূপান্তর , হেক্টর প্রতি কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতি ছিল সবুজ বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । সবুজ বিপ্লব প্রথমে ( ১৯৬৮–১৯৭৮-৭৯ ) সার্থকভাবে দেখা দেয় গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে , যেমন ১৯৬০-৬১ সালে সমগ্র ভারতে যেখানে গমের উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ টন , ১৯৮০-৮১ সালে তা তিনগুণের বেশি বেড়ে হয় ৩ কোটি ৬৩ লক্ষ টন । আর এই গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে পাঞ্জাব , হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । প্রকৃতপক্ষে , প্রথম পর্যায়ে গম উৎপাদনের পরিমাণ এত দ্রুত বেড়ে যায় যে একে অনেকে গম বিপ্লব আখ্যা দেন ।
সবুজ বিপ্লবের প্রভাব বা ফলাফল
সবুজ বিপ্লবের সুফল
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি :
উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার , রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ প্রয়ােগ , ট্রাক্টর , হারভেস্টর প্রভৃতি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি , ক্ষুদ্র ও মাঝারি জলসেচ প্রকল্প রূপায়ণ এবং জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রভৃতির ফলে কৃষিজ ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পায়।
কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি :
সবুজ বিপ্লবের ফলে প্রচুর পরিমান ফসল উৎপাদন হওয়ায় তা বাজারে বিক্রি করে কৃষকরা বেশ ভালো উপার্জন করে , যা তাদের আর্থিক উন্নতিতে সাহায্য করেছিল ।
বহু ফসলি কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন :
সবুজ বিপ্লবের আগে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে ফসল ফলাতে হত বলে, বছরে একবার ফসল উৎপাদন হত। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের ফলে জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটায়, এক ফসলি জমিগুলি বহু ফসলি জমিতে রূপান্তর ঘটেছিলো ।
মৌসুমি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস :
সবুজ বিপ্লবের ফলে জলসেচ ব্যবস্থা পরিকল্পনা রূপায়ণের মাধ্যমে নদী থেকে অসংখ্য খাল কেটে জলসেচ ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো হয়েছিল । এরফলে জমিতে সময় মতো প্রয়োজন অনুসারে জল সরবরাহ করা যেত ।
অনাহারের পরিমান হ্রাস :
সবুজ বিপ্লবের ফলে ফসলের উৎপাদন অনেক বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রায় সকল অভাবী , অনাহারী মানুষকে খাবার পৌছে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল । যার ফলস্বরূপ সবুজ বিপ্লবের পূর্বের মতো বহু মানুষকে খাদ্যের অভাবে আর অনাহারে থাকতে হত না ।
দেশের আর্থিক উপার্জন বৃদ্ধি :
উৎপাদিত কৃষিজ ফসল বিদেশে রপ্তানি করে ভারত সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল , যা দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করেছিল ।
সবুজ বিপ্লবের কুফল
ভূমির অবনমন :
একই জমিতে বছরে দুই থেকে তিন বার চাষ করার ফলে জমির স্বাভাবিক উর্বরতার পরিমান কমে যাচ্ছে । এছাড়া জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে মৃত্তিকা দূষণের পরিমান বৃদ্ধি যাচ্ছে ।
জীব বৈচিত্র্যের হ্রাস :
কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে কৃষিজমির বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে ।
জল দূষণের পরিমান বৃদ্ধি :
জমিতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকগুলি বৃষ্টির জলের মাধ্যমে বাহিত হয়ে জলাশয়গুলির জলকে দূষিত করছে ।
ভৌম জলের পরিমান হ্রাস :
কৃষিজমিগুলিতে জলসেচের জন্য অনেক সময় ভূগর্ভস্থ ভৌম জল ব্যবহার করার ফলে ভৌমজল স্তরের পতন ঘটছে ।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিকাশ :
সবুজ বিপ্লবের ফলে এক শ্রেণীর কৃষক ক্রমশ লাভবান হওয়ায় অন্য দিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর কৃষকরা তেমন লাভ না করতে পারায় সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি :
সবুজ বিপ্লবের ফলে ট্রাক্টর , হারভেস্টর প্রভৃতি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকের চাহিদা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে । এরফলে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে ।