গ্রীন হাউস এফেক্ট

Contents

গ্রীন হাউস এফেক্ট

index 6

বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড , মিথেন , নাইট্রাস অক্সাইড , CFC , জলীয় বাষ্প ইত্যাদি গ্রীন হাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত ঘনত্ব বৃদ্ধির জন্য বায়ুমণ্ডল শীতপ্রধান অঞ্চলে উদ্ভিদ প্রতিপালনের জন্য কাচের ঘরে উত্তাপ ধরে রাখার মতাে আচরণ করে । অর্থাৎ দীর্ঘ তরঙ্গের পার্থিব বিকিরণ ওই গ্রীন হাউস গ্যাসগুলির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় মহাশূন্যে ফিরে যেতে পারে না , পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে । এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যায় । তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ঘটনাকে গ্রীন হাউস এফেক্ট বা গ্রীন হাউস প্রভাব বলে ।

গ্রীন হাউস এফেক্ট এর কারণ

মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের প্রভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড , ক্লোরােফ্লুরােকার্বন , মিথেন , নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিন হাউস গ্যাস অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে । গ্রীন হাউস এফেক্ট এর কারণ গুলি হল一

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার : 

কলকারখানায় , যানবাহন চলাচলে ও অন্যান্য কাজে কয়লা , পেট্রোল , ডিজেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় । এই জীবাশ্ম জ্বালানি গুলির দহনে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় ।

অরণ্য ধ্বংস ও জ্বালানি কাঠের ব্যবহার : 

অতিরিক্ত বৃক্ষ ছেদন এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠ পােড়ানাের ফলে বাতাসে অক্সিজেনের হার কমে যাচ্ছে এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের হার বেড়ে যাচ্ছে ।

ক্লোরোফ্লোরো কার্বন এর অতিরিক্ত ব্যবহার : 

ইলেকট্রনিক্স শিল্প , হিমায়ন প্রক্রিয়া ও রং শিল্পে প্রচুর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা CFC -এর ব্যবহারের ফলে বাতাসে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা CFC অতিরিক্ত পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষিতে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার : 

কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জমিতে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করার ফলে বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড এর পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে । 

জৈব আবর্জনার পচন : 

নানা ধরনের জৈব আবর্জনা পচনের ফলে , জলাশয়ের মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর পচনের ফলে , গবাদি পশুর মলমূত্র এবং ধানখেত থেকে উৎপন্ন মিথেন ( CH₄ ) গ্যাস প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশে যাচ্ছে । 

গ্রিন হাউস গ্যাসের অন্যান্য উৎস বা কারণ : 

ওজোন গ্যাসের ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন , পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বাতাসের জলীয় বাষ্প ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এরফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ।

গ্রীন হাউস এফেক্ট এর প্রভাব বা ফলাফল

বায়ুমণ্ডলের নীচের স্তরে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধির প্রধান ফলাফল হল পৃথিবী জুড়ে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি , যা বিশ্ব উষ্ণায়ন ( Global warming ) নামে পরিচিত । পৃথিবীর এরূপ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কুপ্রভাব পরিবেশে লক্ষ করা যায় । 

জলবায়ুর পরিবর্তন : 

পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ( প্রায় 1.5° সে. বেড়েছে ) পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে । শীতের প্রকোপ কমেছে ও গ্রীষ্মের প্রকোপ বেড়েছে । নাতিশীতাে‌ষ্ণ জলবায়ু উষ্ণতর হচ্ছে । ঋতুগুলোর অনিয়মিত আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে । পৃথিবীতে বজ্র-ঝড় , ঘূর্ণিঝড় , খরা ইত্যাদির প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে । 

সমুদ্রজলের উষ্ণতা বৃদ্ধি : 

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রজলের গড় উষ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে । এর ফলে সমুদ্রজলের কার্বন ডাই অক্সাইড শােষণের পরিমাণ কমছে । পরিণতি স্বরূপ উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটনগুলি কার্বন ডাই অক্সাইডের অভাবে খাদ্য তৈরি করতে পারছে না ও মারা যাচ্ছে । এ ছাড়া , সমুদ্রজলের উষ্ণতা বাড়ায় প্রবাল কীট সহ অন্যান্য বহু জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে । সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্রমশ বিনাশ ঘটছে । 

বরফ ও হিমবাহের গলন : 

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ , জলে ভাসমান হিমশৈল ও পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহ গলতে শুরু করেছে । ফলে সমুদ্রজলের পরিমাণ বাড়ছে । তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য হিমালয়ের অমরনাথ গুহার বরফের শিবলিঙ্গের উচ্চতা কমে গেছে । বিশ্ব উন্নয়নের ফলে হিমবাহের পশ্চাদপসরণ ( glacial retreat ) ঘটছে ও হিমরেখার উচ্চতা বাড়ছে । 

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : 

পুরু বরফের স্তর গলতে থাকায় সমুদ্রজলের পরিমাণ ও জলপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে উপকূলবর্তী এলাকার নীচু অংশ ক্রমশ জলে ডুবে যাবে , ক্ষয়চক্র ব্যাহত হবে , সমুদ্রের নােনা জলের প্রবেশে মাটি অনুর্বর হবে , সমুদ্রজলের উষ্ণতার তারতম্যের জন্য সমুদ্র স্রোতের পরিবর্তন , সামুদ্রিক জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মৃত্যু ঘটবে । 

কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস ও শস্য উৎপাদনের পরিবর্তন : 

তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে দেখা যাচ্ছে যে , কুলু উপত্যকায় আপেল চাষের স্থানে পেঁয়াজ রসুনের চাষ হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে কৃষিজমির পরিমাণও কমছে । 

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস : 

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ চিরতরে হারিয়ে যাবে । 

উদ্ভিদের বিনাশ : 

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ , ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ধ্বংস হবে এবং দাবানলের সংখ্যাও বাড়বে । 

জলের জোগানে ঘাটতি : 

তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাষ্পীভবন তীব্রতর হবে । ফলে ভূপৃষ্ঠে হ্রদ , নদী , জলাশয়ের জলের পরিমাণ কমবে । এ ছাড়া , মৃত্তিকার আর্দ্রতার পরিমাণ হ্রাস পেলে ভূগর্ভের জলে টান পড়বে ।

গ্রীন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের উপায়

গ্রীন হাউস গ্যাস গুলির নির্গমন পুরােপুরি যাতে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো ( 1992 খ্রি. ) , দক্ষিন আফ্রিকার জোহানেসবার্গ ( 2002 খ্রি. ) এবং জাপানের কিয়ােটো শহরে পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনে অনেক প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল । এইসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি গ্রহণ করলে গ্রীন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে । যেমন— 

জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস :

জীবাশ্ম জ্বালানির অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতির ব্যবহার যথাসম্ভব কম করে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের ( CO2 ) পরিমাণ কমাতে হবে । যানবাহনের ক্ষেত্রে অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়াতে হবে।

অপ্রচলিত বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার :

অপ্রচলিত শক্তি বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির অর্থাৎ বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি, ভূতাপীয় শক্তি ও জোয়ার ভাটার শক্তি প্রভৃতির ব্যবহারের প্রবণতা বাড়াতে হবে , যাতে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের ( CO2 ) পরিমাণ বৃদ্ধি না পায় । 

ফ্রেয়ন গ্যাসের উৎপাদন হ্রাস :

ফ্রেয়ন , হ্যালােন , ক্লোরােফ্লুরােকার্বন ( CFC ) ইত্যাদি গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহার কমাতে হবে । 

বনসৃজনে উৎসাহদান :

বনভূমি ধ্বংসের পরিবর্তে নতুন বনসৃজন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যাতে গাছ বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডকে শােষণ করতে পারে । 

প্রযুক্তির উন্নয়ন :

গাড়ি ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যানের প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে জ্বালানির অপচয় ও ব্যবহার কমিয়ে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের ( CO2 ) সঞ্চয় রােধ করতে হবে । 

আবর্জনার প্রক্রিয়াকরণ :

মিথেন উৎপাদনকারী আবর্জনার সঠিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের সঞ্চয় কমাতে হবে । 

জ্বালানির সাশ্রয় :

ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা কমিয়ে জ্বালানির দহন কমাতে হবে । 

পরিবর্ত দ্রব্যের ব্যবহার :

কাঠের পরিবর্ত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ালে বনভূমির প্রসার ঘটবে , ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ( CO2 ) সঞ্চয় কম হবে । 

জনসচেতনতা বৃদ্ধি :

মানুষকে গ্রীন হাউস গ্যাসের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্বন্ধে সচেতন করলে এবং গ্যাস নিয়ন্ত্রণের উপায় আবিষ্কারের জন্য প্রশাসনিক স্তরে গবেষণায় উৎসাহ দান করলেও পরােক্ষভাবে উপকার হবে ।

সরকারী নীতি :

গ্রীনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি কমানোর জন্য গবেষণার কাজে সরকারী সাহায্য ও উৎসাহদান এবং এই গ্যাসগুলি যাতে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে না যায় তার জন্য কঠোর আইন প্রনয়ন অত্যন্ত জরুরী। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!