পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
Contents
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার

আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বলে পরিবেশ । চারপাশের গাছপালা , মাটি , পাথর , নদীনালা , আকাশ বাতাস , সাগর-মহাসাগর , জীবজন্তু ইত্যাদির সমন্বয়ে এই পরিবেশ গঠিত । কিন্তু বর্তমানে যথেচ্ছভাবে গাছ কাটা , জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার , কৃষিকাজে অত্যধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়ােগ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি বা অনিষ্ট হয়ে চলেছে , যাকে পরিবেশ দূষণ বলা হয় । এর ফলে শুধু গাছপালা বা জীবজন্তুর নয় , সমগ্র মানব সভ্যতারই অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে । পরিবেশ দূষণ প্রধানত তিন প্রকার— ( ১ ) ভূমি দূষণ , ( ২ ) জল দূষণ এবং ( ৩ ) বায়ু দূষণ ।
ভূমি দূষণ
প্রধানত মানুষের অবিবেচনা প্রসূত ক্রিয়াকলাপ ও সচেতনতার অভাবে যখন ভূমির উর্বরতা হ্রাস পায় , ক্ষারকীয়তা ও অম্লতা বা লবণতা বৃদ্ধি পায় , ভূমির উপরিভাগের অপসারণ বা ক্ষয় হয় , তাকে ভূমি দূষণ বলে ।
ভূমি দূষণের কারণ :
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত , ভূমিধস , প্রবল বায়ুপ্রবাহ , বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করলেও ভূমি দূষণের প্রধান কারণ মানুষের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ । কারণ কলকারখানা , গৃহস্থালির দূষিত আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ , বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ , তৈলাক্ত পদার্থ , তেজস্ক্রিয় আবর্জনারাশি প্রভৃতির মাধ্যমেই মূলত ভূমি দূষণ ঘটে ।
ভূমি দূষণের প্রভাব :
ভূমি দূষণের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয় ও শস্যের খাদ্যগুণ হ্রাস পায় । মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে , মানুষ ও পশুপাখির শরীরে নানা ধরনের রােগব্যাধি দেখা দেয় , তৃণভূমি ও অরণ্যের বিনাশ ঘটে , জল দূষিত হয় ।
ভূমি দূষণ নিয়ন্ত্রণ :
ভূমি দূষণ বিভিন্ন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় , যেমন — দূষিত আবর্জনা বা বর্জ্য পদার্থ ফেলে না দিয়ে সেগুলি থেকে জৈব গ্যাস ও সার উৎপাদন , কৃষিকাজে ‘ পরিবেশ অনুকূল ’ সার ও কীটনাশকের ব্যবহার , তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহারের সময় যথােপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ , ভূমি দূষণ সম্পর্কে সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রভৃতির মাধ্যমে ভূমি দূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে ।
জল দূষণ
জলের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যখন জলের প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় এবং জলের উপযােগিতা নষ্ট হয় , তখন জলের সেই ক্ষতিকর রূপান্তরকে বলে জল দূষণ ।
জল দূষণের কারণ :
কলকারখানা ও গৃহস্থালির রাসায়নিক আবর্জনাসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ , কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক , শহরের পয়ঃপ্রণালী নির্গত ময়লা ও আবর্জনা , আণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় পদার্থ , দুর্ঘটনাগ্রস্ত জাহাজ নির্গত তৈলাক্ত পদার্থ প্রভৃতি জলে মিশে জলকে দূষিত করে ।
জল দূষণের প্রভাব :
জল দূষণের ফলে মানুষ , সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের ব্যাপক ক্ষতি হয় । এবং মাটি দূষিত হয়ে পড়ে । দূষিত জল ব্যবহারের ফলে মানুষের আন্ত্রিক , আমাশয় , কলেরা , জন্ডিস , টাইফয়েড , চর্মরােগ , কিডনির অসুখ , অ্যালার্জি , এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে । সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আকৃতির মাছ এবং সামুদ্রিক পাখি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কৃষিকাজে দূষিত জল ব্যবহারের ফলে মাটির ক্ষারকীয়তা বা অম্লতা বৃদ্ধি পায় , উপকারী ব্যাকটিরিয়া ও জীবাণুর ক্ষতি হয় এবং উর্বরতা বিনষ্ট হয় ।
জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ :
জল দূষণ বিভিন্ন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় , যেমন — কলকারখানা , গৃহস্থালি , পয়ঃপ্রণালী নির্গত তরল ও বিষাক্ত আবর্জনা শােধন করে নদী ও সমুদ্রে ফেললে জলদূষণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায় । এছাড়া কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করা , খনিজ তেলবাহী জাহাজ চলাচলের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন , তেজস্ক্রিয় আবর্জনারাশি যাতে কোনােভাবে জলে না মেশে সেদিকে লক্ষ রাখা , ভৌম জলের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা ইত্যাদির মাধ্যমেও জলদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
বায়ু দূষণ
বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যখন দূষিত ধোঁয়া , গ্যাস , গন্ধ , বাম্প ইত্যাদি অনিষ্টকর উপাদানের সমাবেশ ঘটে , যার ফলে মানুষ , জীবজন্তু ও উদ্ভিদ জগতের ক্ষতি সাধিত হয় , তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে ।
বায়ু দূষণের কারণ :
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত , জলাভূমি থেকে নির্গত মিথেন গ্যাস , অরণ্যের দাবানল প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে বায়ু কিছুটা দূষিত হলেও মানুষের বিভিন্ন প্রকার ক্রিয়াকলাপের জন্যেই প্রধানত বায়ু দূষণ ঘটে । যেমন — কলকারখানা , খনিজ তেল শােধনাগার , যানবাহন , তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি থেকে নির্গত বিপুল পরিমাণ দূষিত গ্যাস , ছাই , ধোঁয়া , ঠান্ডা মেশিনে ব্যবহৃত ক্লোরােফ্লুরাে কার্বন গ্যাস , গৃহস্থালির জ্বালানি প্রভৃতি বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ ।
বায়ু দূষণের প্রভাব :
বায়ু দূষণের ফলে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হয় , মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের ওপর নানারূপ ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । অ্যাসিড বৃষ্টি , ওজোন স্তরের বিনাশ , কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্টি ‘ গ্রিনহাউস এফেক্ট ’ প্রভৃতি সবই বায়ুদূষণের ফলেই হয় ।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ :
বিভিন্নভাবে এই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় , যেমন — প্রচলিত শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির প্রবর্তন , জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে সৌর শক্তি , বায়ু শক্তি , ভূ-তাপ শক্তি , জৈব গ্যাস প্রভৃতি অপ্রচলিত শক্তির উৎস ব্যবহারের ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ , অরণ্যভূমির পরিমাণ বাড়ানাে , ক্লোরােফ্লুরাে কার্বন গ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রভৃতির মাধ্যমে বায়ু দূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ।