ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত কাকে বলে
Contents
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত কাকে বলে

পৃথিবীর কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী স্থানে যেসব ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয় , তারা ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত নামে পরিচিত । এই প্রকার ঘূর্ণবাতে বজ্র বিদ্যুৎসহ প্রবল ঝড়ের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে । সব ধরনের ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত ক্রান্তীয় সমুদ্রের ওপর উৎপন্ন হয় । বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ( World Meteorological Organisation ) ক্রান্তীয় গােলযােগকে তীব্রতার মাপকাঠিতে তিন ভাগে ভাগ করেছেন , যথা —
ক্রান্তীয় ডিপ্রেশন ( Tropical Depression )
এটি দুর্বল প্রকৃতির ঘূর্ণিঝড় যেখানে একটি নিম্নচাপ কেন্দ্রের চারদিকে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিমির কম থাকে । নিম্নচাপ ব্যবস্থাটি মাত্র কয়েকটি এককেন্দ্রিক বৃত্তাকার সমপ্রেষ রেখা দ্বারা আবদ্ধ থাকে । সমপ্রেষ রেখাগুলি খুব বেশি ঘনসন্নিবিষ্ট থাকে না । এই ধরনের নিম্নচাপ ITCZ- এর নিকট যথেষ্ট বেশি সংখ্যায় থাকে , কিন্তু আয়ন বায়ু বলয়ে কম সংখ্যায় থাকে । এ ধরনের বহু নিম্নচাপ ছােটোখাটো ঝঞ্ঝা তৈরি করে , কিন্তু কোনাে কোনাে ডিপ্রেসন হঠাৎ কোনাে কারণে শক্তিশালী হয়ে প্রধান ঝড়ে পরিণত হয় । এজাতীয় ঘূর্ণবাতে প্রবল ঝঞ্ঝাপূর্ণ বাতাসের সৃষ্টি হয় না ; কেবলমাত্র জোরে বায়ু প্রবাহিত হয় । এরা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় । এইপ্রকার ঘূর্ণবাতে একটানা কয়েকদিন বৃষ্টি হয় । উষ্ণ আর্দ্র সামুদ্রিক বায়ুপুঞ্জ ( যেমন — মৌসুমি বায়ু ) ও শুষ্ক মহাদেশীয় বায়ুপুঞ্জের সংঘর্ষের ফলে এই প্রকার ঘূর্ণবাতের উদ্ভব হয় ।
ক্রান্তীয় ঝড় ( Tropical Storm )
এটি শক্তিশালী ঘূর্ণবাত , যা একটি নির্দিষ্ট গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রকে ঘিরে অবস্থান করে এবং যার চারদিকে বাতাস ঘণ্টায় ৪০ থেকে ১২০ কিমি বেগে প্রবাহিত হয় । সমপ্ৰেষ রেখাগুলি সংখ্যায় অনেক বেশি ও প্রায় এককেন্দ্রিক বৃত্তরূপে ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে অবস্থান করে ।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বা হারিকেন ও টাইফুন শ্রেণির বা প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণবাত ( Tropical Cyclone or Hurricane and Typhoon Type or Very Strong Cyclone )
এটি এক প্রবল ও শক্তিশালী ঘূর্ণবাত , যার কেন্দ্রে একটি অতি গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্র থাকে । ঘূর্ণবাতের চারদিকে কমপক্ষে ঘণ্টায় ১২০ থেকে ৩০০ বা ৪০০ কিমি পর্যন্ত বেগে বাতাস বয়ে যায় । এই ঘূর্ণবাতে সমচাপ রেখাগুলি সম্পূর্ণ বৃত্তাকার ও খুব ঘন সন্নিবিষ্ট থাকে । চাপের পার্থক্য কখনও কখনও ৪০ মিলিবার হয়ে যায় । এই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় সচরাচর ঘটে না এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলের কেবলমাত্র নির্দিষ্ট এলাকায় উভয় গােলার্ধের ৫° অক্ষরেখার মধ্যে ঘটে । এই ঝড় কেবল জলভাগের ওপর জন্মলাভ করে ও ওই স্থানে পরিণতি লাভ করে ; তা সত্ত্বেও উপকূলবর্তী অঞ্চল ও দ্বীপ সমূহ এদের রােষ প্রত্যক্ষ করে ।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির শর্ত
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তির শর্তগুলো হলো —
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাপ ও লীনতাপ :
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ( Sea – Surface Temperature ) ২৭ ° সেঃ বা তার বেশি হলে যথেষ্ট পরিমাণ বাষ্পীভবন ঘটে । ফলে , বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প মিশে যায় , যা প্রয়ােজনীয় লীনতাপ প্রদান করে ।
উষ্ণ জলের গভীরতা :
২৭° সেঃ উষ্ণতায় জলের গভীরতা অনধিক ৬০-৭০ মিটার হওয়া আবশ্যক হয় । তা না হলে গভীর পরিচলন স্রোতের জন্য নীচের শীতল জল ওপরে উঠে এলে তাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় ও ঘূর্ণবাত বিলীন হয়ে যায় ।
বায়ুমণ্ডলের নীচু স্তরে গােলযােগের উপস্থিতি :
ITCZ- এ পূবালি বায়ুতরঙ্গের অবস্থান ঝড়কে প্রাথমিকভাবে বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে ।
উর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গােলযােগ :
উর্ধ্ব ট্রপােস্ফিয়ারে কোনাে নাতিশীতােষ্ণ ঘূর্ণবাতের পরিত্যক্ত ট্রাফ ( trougth ) থাকলে , তার কেন্দ্রে শীতল বাতাস থাকে । এই বাতাস প্রচুর লীনতাপ ত্যাগ করলে ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয় ।
কোরিওলিস বল :
বাতাসকে তরঙ্গের মতাে পরিচালিত করতে ন্যূনতম কোরিওলিস বল প্রতি সেকেন্ডে 10-5 ডাইন হওয়া বাঞ্ছনীয় । ৫° অক্ষাংশে যে বল থাকে , তা ঘূর্ণবাতের ঘূর্ণি সূচনা করতে পারে না । এই বল ৫° অক্ষাংশের পর বৃদ্ধি পায় । এইজন্য অধিকাংশ ঝড় ১৫° অক্ষাংশ সংলগ্ন অঞ্চলে সংঘটিত হয় ।
বাতাসের ন্যূনতম উল্লম্ব উত্থান :
বাতাসকে একটি নূনতম উচ্চতায় উঠতে হয় , যেখানে ঘনীভবনের ফলে উদ্ভূত লীনতাপ ঘূর্ণবাতের প্রয়ােজনীয় শক্তির জোগান দিতে পারে । এছাড়া বাতাস ঊর্ধ্বগামী হলে অন্তঃপ্রবাহ ( Inflow ) বজায় থাকে ও চিমনি গঠনের মাধ্যমে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটায় ।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত এর গঠন
( ১ ) ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ব্যাস প্রায় ২০০-০০ কিমি ও উচ্চতা প্রায় ১২-১৬ কিমি হয় । বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৬০ কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে ।
( ২ ) ঘূর্ণবাতের একটি বৃত্তাকার কেন্দ্র থাকে , যাকে ঝড়ের চক্ষু বলা হয় । এর ব্যাস ১০-২০ কিমি হয় , মতভেদ ৫-৫০ কিমি হয় ।
( ৩ ) গ্যালাক্সির মতাে দেখতে শত শত কিমি দীর্ঘ ও কয়েক কিমি প্রশস্ত মেঘের কুণ্ডলী থাকে ।
( ৪ ) ঘূর্ণবাতের আকৃতি গােলাকার থেকে ডিম্বাকারে পরিণত হয় ।