ভূগোল

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত কাকে বলে

Contents

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত কাকে বলে

index 19
নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত কাকে বলে

মধ্য অক্ষাংশে পশ্চিমা বায়ু স্রোতের সঙ্গে যেসব ঘূর্ণবাতের উদ্ভব ঘটে , তারা নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত নামে পরিচিত । এই অঞ্চল নিম্ন চাপ ও উচ্চ চাপ ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় । নিম্ন চাপকে ভরাট করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শুষ্ক ও শীতল বায়ু এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু ছুটে আসে । এই দুই বিপরীতধর্মী বায়ুপুঞ্জের বাতাগ্রতল বা সীমান্ততল ( Frontal surface ) বরাবর বায়ুমণ্ডলে তরঙ্গের মাধ্যমে আলােড়ন সৃষ্টি হয় ও তার প্রভাবে ঘূর্ণবাতের উদ্ভব ঘটে । 

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি সম্বন্ধে দু-ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে , যথা — 

( ক ) মেরু বাতাগ্র বা মেরু সীমান্ত ( Polar Front ) মতবাদ বা তরঙ্গ মতবাদ ( Wave Theory ) , এবং 

( খ ) ব্যারোক্লিনিক তরঙ্গ মতবাদ  ( Baroclinic Wave Theory ) । 

মেরু বাতাগ্র মতবাদ বা তরঙ্গ মতবাদ

এই মতবাদের প্রবর্তক হলেন ভি. বার্কনেস ( Vilhelm Bjerknes ) ও অন্যান্য নরওয়ের আবহাওয়াবিদ । এই মতবাদ অনুযায়ী মেরুবাতাগ্র ; মেরু বায়ুপুঞ্জ ও ক্রান্তীয় বা উপক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জকে সীমান্তপৃষ্ঠ বরাবর পৃথক করে রাখে এবং ওই সীমান্তপৃষ্ঠে তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে ঘূর্ণবাতের উদ্ভব হয় । আবহাওয়াবিদেরা ঘূর্ণবাতের উৎপত্তিকে চারটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেছেন । এই পর্যায়গুলি নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র বলে পরিচিত । এদের সম্বন্ধে নীচে আলােচনা করা হল — 

প্রারম্ভিক পর্যায় ( Initial Stage ) :

ঘূর্ণবাত সৃষ্টির প্রারম্ভে মেরু অঞ্চল থেকে আগত ভারী , শীতল ও শুষ্ক মেরু বায়ুপুঞ্জ এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত হালকা , উষ্ণ ও আর্দ্র উপক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জ ( পশ্চিমা বায়ু ) নাতিশীতােষ্ণ অঞ্চলে উপস্থিত হওয়ার পর এই দুই বায়ুপুঞ্জ পরস্পরের বিপরীতে প্রবাহিত হয় । মেরু বায়ুপুঞ্জ পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে এবং উপক্ৰান্তীয় বায়ুপুঞ্জ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় । এই দুই বায়ুপুঞ্জ খুব কাছাকাছি চলে এলে এদের মাঝখানে একটি সীমান্ত বা বায়ুপ্রাচীরের সৃষ্টি হয় এবং ওই সীমান্ত বরাবর অত্যন্ত মৃদু আলােড়ন শুরু হয় । এই পর্যায়ে সীমান্ত প্রায় একই জায়গায় স্থির থাকে । এ সময়ে বাতাসের কোনােপ্রকার স্থানান্তর ঘটে না । 

জায়মান বা জন্মলাভ পর্যায় ( Incipient Stage ) :

এই পর্যায়ে সীমান্তপৃষ্ঠে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় । আঞ্চলিকভাবে পাহাড় পর্বতের অবস্থানের জন্য কিংবা বায়ুর চাপঢালের পরিবর্তনের ফলে উত্তর গােলার্ধে শীতল বায়ুপুঞ্জ দিক পরিবর্তন করে । উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং গোঁজের আকারে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করে । শীতল বাতাস উষ্ণ বায়পুঞ্জের ভিতর ঢুকে শীতল সীমান্ত সৃষ্টি করে । শীতল বায়ুপুঞ্জ এভাবে উষ্ণ বায়ুকে ধাক্কা দিলে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জ সংকুচিত হয় এবং দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয় । উষ্ণ বায়ু শীতল বায়ুপুঞ্জকে সরিয়ে দিয়ে উষ্ণ সীমান্ত সৃষ্টি করে । এই অবস্থায় উষ্ণ ও শীতল সীমান্তের মিলন বিন্দুতে একটি তরঙ্গশীর্ষ ( Wave crest ) সৃষ্টি হয় । এভাবে ঘূর্ণবাত জন্মলাভ করে ।

পরিণত পর্যায় ( Mature Stage ) :

পরিণত পর্যায়ের প্রথম ভাগে সীমান্ত বরাবর তীব্র আলােড়ন শুরু হয় । তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তার ও বক্রতা উল্লেখযােগ্য ভাবে বেড়ে যায় । এ সময়ে উষ্ণ ক্ষেত্র থেকে শীতল ক্ষেত্রের দিকে বাতাসের প্রবাহ শুরু হয় । ভারী শীতল বাতাস মাটি ঘেঁষে হালকা উষ্ণ বাতাসকে দ্রুত সরাতে থাকে , কিন্তু উষ্ণ বাতাস শীতল বাতাসকে ঠেলে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে না । ফলে , তখন উষ্ণ বাতাস শীতল বাতাসের সঙ্গে গঠিত একটি তির্যক তল , অর্থাৎ , উষ্ণ সীমান্ত বরাবর ওপরের দিকে দ্রুত উঠতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শীতল বায়ুপুঞ্জকে সরাতে থাকে । এই সময় তরঙ্গের বিস্তার ও বক্রতা সবচেয়ে বেশি হয় এবং ঘূর্ণবাত পরিণতি লাভ করে , অর্থাৎ , ঘূর্ণবাত পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় । এই অবস্থায় ঘূর্ণবাত উষ্ণ ও শীতল — এই দুটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত থাকে । উষ্ণ বায়ু ওপরে উঠে ঘনীভূত হয় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় । উষ্ণ সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় । এই পর্যায়ের শেষ পর্বে উষ্ণ ক্ষেত্র দ্রুত সংকীর্ণ হতে শুরু করে , অর্থাৎ , আয়তনে ছােটো হয়ে আসে এবং অচিরেই শীতল সীমান্ত শীর্ষ বিন্দুর নিকটবর্তী উষ্ণ সীমান্তকে ধরে ফেলে বা উষ্ণ সীমান্তের নাগাল পেয়ে যায় । এ সময় থেকে বন্ধ বাতাগ্র বা অন্তর্লীন পর্যায় ( Occlusion Stage ) শুরু হয় । 

বন্ধ বাতাগ্র বা অন্তর্লীন পর্যায় ( Occlusion Stage ) :

এই পর্যায়ে শীতল সীমান্ত ধীর গতি সম্পন্ন উষ্ণ সীমান্তকে অবশেষে অতিক্রম ( over take ) করে যায় ; ফলে , তখন একটি বন্ধ বাতাগ্র বা অন্তর্লীন বাতাগ্র ( Occluded front ) গঠিত হয় । অন্তর্লীন অবস্থা প্রথমে তরঙ্গের শীর্ষবিন্দু থেকে শুরু হয় , যেখানে উষ্ণ সীমান্ত ও শীতল সীমান্তের মধ্যে কোনাে ফাঁক থাকে না । ক্রমান্বয়ে অন্তর্লীন প্রক্রিয়া তরঙ্গশীর্ষ থেকে নীচের দিকে অগ্রসর হয় । শীতল বায়ুর প্রবাহে এভাবে উষ্ণ ক্ষেত্রটি ধীরে ধীরে ভূ পৃষ্ঠের সঙ্গে সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে ওপরে উঠে যায় । পরিশেষে সমগ্র অঞ্চলটিকে শীতল বায়ুপুঞ্জ দখল করে নেয় এবং কেবলমাত্র শীতল বাতাসের এক ঘুর্ণিই থেকে যায় । তখন অন্তর্লীন বাতাগ্রের আর কোনাে অস্তিত্ব থাকে না । ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপশক্তির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘূর্ণবাতের মৃত্যু ঘটে । 

ব্যারোক্লিনিক তরঙ্গ মতবাদ

এই মতবাদ অনুসারে মেরু বায়ুপুঞ্জ ‌ও ক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জের মাঝখানে কোনাে সীমান্ত ( Front ) ছাড়াই ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হতে পারে । তবে এই দুই ভিন্নধর্মী বায়ুপুঞ্জের অভিসারী সীমানা অংশে একটি বাতাগ্র অঞ্চল ( Frontal Zone ) সৃষ্টি হয় । ওই অঞ্চলে বায়ু চঞ্চল হয়ে ওঠে ও ঘূর্ণবাতের জন্ম দেয় । সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে সমচাপ পৃষ্ঠ ( Isobaric surface ) ও সমঘনত্ব পৃষ্ঠ ( Equal density surface ) পরস্পরের সমান্তরালে অবস্থান করে । সমঘনত্ব পৃষ্ঠকে সমােষ্ণ রেখা দ্বারা চিহ্নিত করা হয় ।

কিন্তু বায়ুমণ্ডলে কখনও কখনও এমন অবস্থা ঘটে যে , সম চাপতল ও সমাে‌ষ্ণ তল বা সমঘনত্ব পৃষ্ঠ পরস্পরের সমান্তরালে অবস্থান না করে এক পৃষ্ঠের সঙ্গে অন্য পৃষ্ঠ‌ তির্যক অথবা উল্লম্ব ছেদক তলে অবস্থান করে । তখন ওই ছেদক তল বরাবর তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটে । বায়ুমণ্ডলে সমােষ্ণ তল যদি সমচাপ পৃষ্ঠের সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান না করে ওই পৃষ্ঠকে ছেদ করে একটি তির্যক বা উল্লম্ব তলে অবস্থান করে , তাহলে সমচাপ পৃষ্ঠ বরাবর তাপমাত্রার পার্থক্য জনিত যে অবস্থার সৃষ্টি হয় , তাকে ব্যারোক্লিনিক অবস্থা বলে । এই দুই ভিন্নধর্মী স্তর পরস্পরের সমান্তরালে অবস্থান করলে , তাকে ব্যারোট্রপিক অবস্থা বলে ।

ওই ছেদকতল বরাবর সমচাপ পৃষ্ঠতে তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে , অর্থাৎ , পারিপার্শ্বিক আবহমণ্ডলের সাপেক্ষে বায়ুর তাপমাত্রা বেশি থাকে । ফলে , বায়ুর চাপঢাল খুব খাড়া হয় এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে বাতাসের গতিবেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও নীচের বাতাস উর্ধ্বে উঠে যায় । তখন ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে চারদিক থেকে বাতাস বেগে ছুটে আসে । কোরিওলিস বলের জন্য বাতাস আবর্তিত হতে থাকে এবং একটি ঘূর্ণির ( cyclonic vortex ) সৃষ্টি করে । বাতাস ঘূর্ণি অক্ষের যত নিকটবর্তী হয় তত তার গতি বেগ বেড়ে যায় । এভাবে সীমান্তহীন অবস্থায় নাতিশীতাে‌ষ্ণ ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হতে পারে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!