সাম্প্রদায়িকতার অর্থ ও স্বরূপ
Contents
সাম্প্রদায়িকতার অর্থ ও স্বরূপ
‘ সাম্প্রদায়িকতা ’ — এই শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে । ইংরেজি শব্দ ‘ Communalism ’ -এর বাংলা অর্থ হল সাম্প্রদায়িকতা । উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে কোনাে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষমূলক বা ঘৃণার ভাবকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে অভিহিত করা হয় । বিংশ শতকে সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির অর্থে অনেক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে ।

ব্যাপক অর্থে
যখন আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের সার্বিক ক্ষতিসাধন করে , তখন সাম্প্রদায়িকতার অর্থ সম্পূর্ণতা পায় । আইনসলি এমব্রি ( Ainslie Embree) তাঁর ‘ আন্ডারস্ট্যান্ডিং কনটেমপােরারি ইন্ডিয়া ’ গ্রন্থে বলেছেন যে — ভারতে ব্যাপক অর্থে সাম্প্রদায়িকতা বলতে গােষ্ঠীগত পরিচয় আর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলির ওপর জোর দেওয়া হয় , যা কিনা একটি বিশেষধর্মের প্রতি অনুগত ।
হিন্দু – মুসলিম বিভেদ অর্থে
বঙ্গভঙ্গকালে হিন্দু – মুসলিম ঐক্যে যে ফাটল ধরে তা সাম্প্রদায়িকতাকে আরও স্পষ্ট করে তােলে । রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় — “ হিন্দুর কাছে মুসলমান অশুচি , আর মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের , এই মনােভাব সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষাক্ত শব্দটিকে অর্থপূর্ণ করে তুললাে ।
সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ অর্থে
ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের শাসন কায়েম রাখার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভেদরেখা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটায় । ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে — সাম্প্রদায়িকতা হল ঔপনিবেশিকতাবাদের এক উপজাত বস্তু ( ‘ one of the by – products of colonialism ’ )।
সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ
সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃত রূপ আজকে আমরা যা দেখি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে তার স্বরূপ কিছুটা আলাদা ছিল। সেই সময়ের সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে —
সংকীর্ণ ধর্মীয় স্বার্থ :
সাম্প্রদায়িক মনােভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা সর্বদা নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থই চিন্তা করে । সাম্প্রদায়িকতা ধর্মনিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে দেশ , সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন রূপকে বিচার করে না । একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র স্বার্থই বড়াে বলে বিবেচিত হয় ।
পরস্পর স্বার্থবিরােধী :
সাম্প্রদায়িক মতবাদে বিশ্বাসীরা সদা এই মত প্রচার করে থাকেন যে , আলাদা আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থও আলাদা আলাদা । হিন্দু ও মুসলমান যেহেতু আলাদা দুটি সম্প্রদায় , তাই উভয়ের স্বার্থ কখনও এক হতে পারে না ।
আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদ :
অন্ধ সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে বিশ্বাসীরা এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে অপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থগুলিকে এত আলাদা করে দেখে যে , তাদের মধ্যে কখনােই মিলন হয় না ।
হিংসাত্মক রূপ ধারণ :
পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাত থেকে সাম্প্রদায়িকতা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছােয় যে , তা হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে । যার পরিণামস্বরূপ অপেক্ষাকৃত আঞ্চলিকভাবে দুর্বল সম্প্রদায়কে হিংসার বলি হতে হয় ।
উপসংহার
আজও জাতীয়তাবােধ নামক গর্বের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার । সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ অনুসারে কোনাে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সামাজিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বার্থগুলি আলাদা – আলাদা হয় । ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছেন — সাম্প্রদায়িকতা হল এক ধর্মভিত্তিক সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বরূপ প্রকাশক মতাদর্শ ( … the ideology of a religion based socio – political identity ‘ ) ।