দাক্ষিণাত্য কৃষক বিদ্রোহের কারণ
Contents
দাক্ষিণাত্য কৃষক বিদ্রোহের কারণ
মহাজনদের শােষণ , কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ , উচ্চ রাজস্ব হার আরােপসহ বিভিন্ন কারণে দাক্ষিণাত্যের পুনা ও আহম্মদনগরে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিল তা দাক্ষিণাত্য কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত । নীল চালর্সওয়ার্থের মতে — উচ্চ রাজস্বের বিরুদ্ধেই মূলত দাক্ষিণাত্যে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল (‘ The Deccan riots could hardly have been a protest against high taxation ’) ।

রায়তওয়ারি ব্যবস্থার কুফল
কোম্পানি ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি আয় বাড়ানাের লক্ষ্যে দাক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রবর্তন করে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত । এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের ভার ছিল মােড়ল অর্থাৎ প্যাটেলের ওপর , যারা রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে কৃষকদের নানাভাবে অত্যাচার করত । কৃষকরা রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সম্পত্তি ক্রোক করা হত । এই রাজস্ব ব্যবস্থার সমালােচনা করে কার্ল মার্কস তাঁর গ্রন্থ ‘ On Colonialism ‘ – এ মন্তব্য করেছেন — ভারতে ব্রিটিশ সরকারের আয়ের ৩/৫ অংশ আসে ভূমি থেকে ।
কুনবি কৃষকদের দুরবস্থা
মহারাষ্ট্রের পুনা ও আহম্মদনগর জেলায় কুনবি সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকরা সাউকার ( মহাজন ) বা বনিদের ( গ্রামীণ মহাজন ) হাতে সবথেকে বেশি শােষিত ও অত্যাচারিত হয় । সুযােগ পেলেই সাউকাররা ‘ কুনবি ’ দের জমি – ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সম্পত্তি গ্রাস করত । অত্যাচারিত কৃষকরা পুলিশের কাছে নালিশ জানালেও প্রশাসন নীরব থাকত । অনেকক্ষেত্রে পুলিশরা সাউকারদের পক্ষ নিয়ে কুনবি কৃষকদের ওপর দ্বিগুণ অত্যাচার করত । এতে কুনবি কৃষকরা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ।
মহাজনদের শোষণ
অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ থেকে চাষিরা চড়া সুদের ( ৩০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ) বিনিময়ে টাকা , বীজধান ও খাদ্যশস্য ধার নিত । দাক্ষিণাত্য জুড়ে মহাজনি কারবার চালানাে গুজরাতি , মাড়ােয়ারি , লিঙ্গায়েত ও কুলকার্ণি মহাজনদের শিকার ছিল অসহায় কৃষকরা । ইয়ান ক্যাটানাক – এর মতে — এই বিদ্রোহে কৃষকদের আক্রমণের লক্ষ ছিল বহিরাগত মাড়ােয়ারি ও গুজরাতি মহাজন বা সাউকার ।
তুলাের মূল্য হ্রাস
আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলে পুনরায় সেখান থেকে ইংল্যান্ডে তুলাে রপ্তানি শুরু হয় । ফলে ভারত থেকে তুলাে রপ্তানি কমে যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তুলাের দামও হ্রাস পায় । কিন্তু এদিকে সরকারি তরফে ভূমিরাজস্বের হার এবং মহাজনদের সুদের হার বাড়তেই থাকে । ফলে কৃষকরা বিদ্রোহী হয় । ঐতিহাসিক এল. নটরাজনের মতে — দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল তুলাের মূল্য হাস ।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ
উনিশ শতকের সাতের দশকে দক্ষিণ ভারতে এক চরম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় —
- অনাবৃষ্টি ( ১৮৬৬ – ১৮৬৭ খ্রি . ) , অজন্মা ( ১৮৬৭ – ৬৮ ও ১৮৭৩ খ্রি . ) সেখানকার কৃষকসমাজকে অসহায় করে তােলে ।
- তার ওপর ১৮৭০ – ৭১ – এ কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস পেলে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে ।
- সেই সঙ্গে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সরকার রেলপথ নির্মাণ স্থগিত করে দিলে শ্রমিকশ্রেণির আয়ের আরও একটা পথ বন্ধ হয়ে যায় ।
- ওই সময় আবার বােম্বাই সরকার জমির খাজনা প্রায় দেড়গুণ বাড়িয়ে দেয় ।
দাক্ষিণাত্য কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ
পুনা জেলার অন্তর্গত সিরুর তালুকে কারদে নামক গ্রামে এক মাড়ােয়ারি সুদখাের মহাজন এই বিদ্রোহের বারুদে অগ্নিসংযােগ করেন । ১৮৭৪ – এর ডিসেম্বরে কালুরাম নামক জনৈক মহাজন বাবাসাহেব দেশমুখ নামক এক ঋণগ্রস্ত কৃষকের বাড়ি – জমিসহ সব সম্পত্তি নিলামে মাত্র ১৫০ টাকায় কিনে নিলে গ্রামের অধিবাসীরা কেংলিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘটায় । কারণে গ্রাম থেকে এই বিদ্রোহ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ইন্দাপুর , পুরন্দর , পুনা , আহম্মদনগরসহ প্রায় ৩৩টি জেলায় ।