লর্ড কার্জন কেন বঙ্গভঙ্গ করেন
Contents
লর্ড কার্জন কেন বঙ্গভঙ্গ করেন
উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে ব্রিটিশ শাসক গােষ্ঠী শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার দ্রুত প্রসার দেখে ভীত হয়ে পড়ে । সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরাচারী গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন এই ভীতি থেকেই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন । তিনি বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ( ১৯০৫ খ্রি. ১৬ অক্টোবর ) ‘ পূর্ববঙ্গ ও আসাম ’ এবং ‘ বঙ্গদেশ ’ নামে দুটি প্রদেশে ভাগ করেন । পরবর্তী বড়ােলাট মিন্টো বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে বলেছিলেন — রাজনৈতিক কৌশলরূপে বঙ্গব্যবচ্ছেদ নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট ছিল ।

বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের উদ্দেশ্য
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে ব্রিটিশ প্রকাশ্য উদ্দেশ্যরুপে যা ঘােষণা করেছিল তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল প্রকৃত কিছু উদ্দেশ্য ।
লর্ড কার্জনের প্রকাশ্য উদ্দেশ্য :
- ভৌগােলিক বিচারে আয়তনে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৯০০ বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ লােকসংখ্যা বিশিষ্ট বঙ্গপ্রদেশটি একজন গভর্নরের অধীনে শাসন করা সম্ভব নয় । তাই সরকারি তরফে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ।
- আসামকে বাংলা থেকে আলাদা করে দিলে আসামের সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে ।
- স্বতন্ত্র প্রদেশরূপে আসাম গঠিত ( ১৮৭০ খ্রি. ) হলেও সেখানে দক্ষ প্রশাসনের অভাব ছিল । আসাম পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হলে সে অভাব পূরণ হবে ।
- বাংলার যাবতীয় উন্নয়ন কলকাতাকেন্দ্রিক হওয়ায় পূর্ববঙ্গ , আসাম , ওড়িশায় সেই অর্থে উন্নতির অভাব ছিল । তাই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে ঢাকাকে রাজধানী করে উন্নয়ন ঘটানাে সম্ভব হবে ।
- মুসলিমপ্রধান পূর্ববঙ্গ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা অস্তিত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলে চাকরি ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিমদের সুযােগসুবিধা অনেক বেড়ে যাবে ।
লর্ড কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য :
কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য গুলি ছিল —
বাঙালির ঐক্য ও সংহতি বিনাশ :
বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে কার্জন চেয়েছিলেন হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বাঙালির সংহতিকে সমূলে বিনাশ করতে । উনিশ শতক থেকেই বাংলার মনীষীগণ নবজাতীয়তাবােধ ও নবজাগরণের যে সূচনা ঘটিয়েছিলেন তার প্রভাব পড়েছিল সারা ভারতবর্ষেই । বাংলার ঐক্যের বিনাশের প্রয়ােজন প্রসঙ্গে রিজলি এক অফিসিয়াল নােট – এ লিখেছিলেন — ঐক্যবদ্ধ বাংলা এক বিরাট শক্তি । বাংলা বিভক্ত হলে এই ঐক্য থাকবে না । আমাদের লক্ষ্য সংঘবদ্ধ শত্রুপক্ষকে খণ্ড করে দুর্বল করে ফেলা ।
জাতীয় কংগ্রেসকে দুর্বল করা :
জাতীয় কংগ্রেসের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা । তখন কলকাতা থেকেই কংগ্রেস দল সমগ্র ভারতে আন্দোলন পরিচালনা করত । তাই কার্জন চেয়েছিলেন বঙ্গ বিভাজনের দ্বারা পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা করে দিয়ে কলকাতা কেন্দ্রিক জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকলাপের ওপর আঘাত হানতে ।
ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি :
বাংলা দেশ ভাগের মাধ্যমে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে পরােক্ষভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হীনবল ও পঙ্গু করে দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন কার্জন । জাতীয়তাবাদীদের মতে — সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন ও বিভাজনের নীতিকে আড়াল করার জন্যই প্রশাসনিক সুবিধাগত যুক্তিগুলি উপস্থাপিত করে ।