ইতিহাস

কাউন্ট ক্যাভুরের অবদান

Contents

কাউন্ট ক্যাভুরের অবদান

জাতির আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ম্যাৎসিনি ইতালির ঐক্যের জন্য যে যজ্ঞ শুরু করেছিলেন তাকে সম্পূর্ণ করতে প্রয়ােজন ছিল এক বাস্তববাদী কর্মযােগী পুরােহিতের । এই মানুষটিই হলেন কাউন্ট ক্যামিলাে বেনসাে ডি ক্যাভুর ( ১৮১০-১৮৬১ খ্রি. ) । ইতালির এই উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কটির জন্ম ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্টের এক অভিজাত পরিবারে । জন্মসূত্রে রক্ষণশীল হলেও তিনি ছিলেন উদারপন্থী দেশপ্রেমিক । ইতালিকে আধুনিকরূপে গড়ে তােলার কৃতিত্ব ক্যাভুরেরই । তাই ফিলিপস  বলেছেন – ক্যাভুর ছিলেন আধুনিক ইতালির গঠনকর্তা (‘ Cavour was the maker of modern Italy ’) ।

images 14
ক্যাভুর

কাউন্ট ক্যাভুরের আদর্শ

ক্যাভুরের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে রক্ষণশীলতা ও উদারতার এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় । প্রজাতন্ত্রের প্রতি চরম অনাস্থা যদি তাঁর রক্ষণশীলতার পরিচয় হয় , নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা তাঁর উদারনৈতিকতারই পরিচায়ক । সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ক্যাভুরের আদর্শ ছিল ইংল্যান্ডের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ।

কাউন্ট ক্যাভুরের লক্ষ্য ও কর্মসূচি

ক্যাভুর বিশ্বাস করতেন , ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইউরােপের রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলি তাকে বাঁচতে দেবে না । তাই ইতালিতে একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এই ধুরন্ধর রাজনীতিকের লক্ষ্য ছিল । এই লক্ষ্যে তাঁর প্রধান কর্মসূচি ছিল —

1. সার্ডিনিয়া – পিডমন্টের নেতৃত্বে ইতালিতে ঐক্য আন্দোলন গড়ে তােলা ;

2. শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দ্বারা পিডমন্ট – সার্ডিনিয়াকে উপযুক্ত করে গড়ে তােলা ;

3. ইতালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত করে সার্ডিনিয়া – পিডমন্টের পক্ষে বিদেশি সাহায্য লাভ করা ;

4. ইতালি থেকে অস্ট্রিয়ার আধিপত্য নির্মূল করা ;

5. ঐক্যবদ্ধ ইতালিতে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটানাে ।

কর্মপ্রচেষ্টা :

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দলনেতা মাসিমাে দ্য আজেগলিয়ােকে সরিয়ে ক্যাভুর পিয়েডমন্টের প্রধানমন্ত্রী হন । প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি নিজ উদ্দেশ্যকে কার্যকারী করতে সার্ডিনিয়া – পিডমন্টে কৃষি , শিল্প , বাণিজ্য , সামরিক , শাসনতান্ত্রিক ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যাপক সংস্কার শুরু করেন । ক্যাভুরের প্রচেষ্টাতেই পিডমন্ট সার্ডিনিয়ায় শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল । ডেভিড টমসন  ক্যাভুরের এই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রচেষ্টার মূল্যায়নে লিখেছেন — ক্যাভুরের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি হল তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের ভিত্তি (‘ Cavour’s economic reforms were the basis of his political success ’) ।

ইতালিবাসীর সমস্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করতে তিনি ইংল্যান্ডের মর্নিং পােস্ট , দি টাইমস এবং ফ্রান্সের লা – মার্টিন , লা – ইন্ডিপেন্ডেন্স বেলগি ইত্যাদি সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে জনমত গঠন এবং অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্য লাভে সচেষ্ট হন ।

ক্যাভুর উপলদ্ধি করেছিলেন যে — সামরিক শক্তিতে বলীয়ান না হলে , ইতালি কখনাে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন হতে পারবে না । তাই তিনি সামরিক খাতে খরচ বাড়িয়ে পিডমন্টের সেনাসংখ্যা ও নৌবহরের শক্তি বাড়ান ।

কাউন্ট ক্যাভুরের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ( ১৮৫৪-৫৬ খ্রি. ) যােগদান

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইঙ্গ – ফরাসি পক্ষে অযাচিতভাবে ১৫ হাজার সার্ডিনীয় সৈন্য পাঠিয়ে দেন । ফলে যুদ্ধাবসানে প্যারিস শান্তি বৈঠকে ( ১৮৫৬ খ্রি. ) ক্যাভুর আমন্ত্রিত হন । এই বৈঠকে ক্যাভুর ইতালির সমস্যাকে একটি ইউরােপীয় সমস্যায় পরিণত করতে এবং তার সমাধানে ফরাসি সম্রাট ও ইংল্যান্ডের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন । ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রেরিত সেনাদের উৎসাহ দিয়ে ক্যাভুর বলেন — প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করাে । ভগবানের দয়ায় এই ক্রিমিয়ার মাটি থেকেই নতুন ইতালির জন্ম হবে ।

কাউন্ট ক্যাভুরের প্লোমবিয়ার্স – এর চুক্তি স্বাক্ষর

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্লোমবিয়ার্স নামক স্থানে ক্যাভুর ও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়নের মধ্যে প্লোমবিয়ার্স – এর মৌখিক চুক্তি হয় । কিন্তু এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৮৫৯ খ্রি. জানুয়ারিতে । এতে তিনটি শর্ত ছিল—

1. অস্ট্রিয়া যদি পিডমন্ট – সার্ডিনিয়াকে আক্রমণ করে তবেই ফ্রান্স ক্যাভুরকে সাহায্য করবে ।

2. অস্ট্রিয়ার হাত থেকে মিলান , লম্বার্ডি ও ভেনিস মুক্ত করা সম্ভব হলে ক্যাভুর ফ্রান্সকে নিস্ ও স্যাভয় ছেড়ে দেবেন।

3. রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলের কন্যা ক্লটিলডের সঙ্গে নেপােলিয়নের আত্মীয় জেরােমের বিবাহ হবে । গর্ডন ক্রেগের  মতে এই চুক্তিটি ছিল যুদ্ধ সৃষ্টির প্রচেষ্টা (‘ It was a deliberate attempt to manufacture a war ’) ।

কাউন্ট ক্যাভুরের অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

দেশে ফিরে ক্যাভুর এক কূটনৈতিক চালে অস্ট্রিয়াকে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে বাধ্য করেন । ১৮৫৯ খ্রি. অস্ট্রিয়া পিডমন্ট – সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলে ফ্রান্স ক্যাভুরের পক্ষে যােগদান করে । ফলে ফ্রান্স ও সার্ডিনিয়ার যুগ্মবাহিনীর কাছে অস্ট্রিয়া ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনাের যুদ্ধে পরাজিত হয় । এর ফলে পিডমন্ট – সার্ডিনিয়া ও ফরাসি বাহিনী অস্ট্রিয়ার কবল থেকে লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার করে এবং অঞ্চল দুটি ইতালিভুক্ত হয় । কিন্তু এই যুদ্ধজয়ের ফলে ফ্রান্সবাসীর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় তৃতীয় নেপােলিয়ন অনুভব করেন ইতালির শক্তিবৃদ্ধি ফ্রান্সের পক্ষে বিপজ্জনক । তাই তিনি ক্যাভুরের সঙ্গে কোনাে আলােচনা না করেই হঠাৎ অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি ( ১৮৫৯ খ্রি. ) নামে এক গােপন যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে সসৈন্যে স্বদেশ ফিরে যান । যাইহােক মিলান ও লম্বার্ডি সার্ডিনিয়ার অধিকারে এলে ইতালির ঐক্যের প্রথম ধাপ শেষ হয় । তবে ভেনিস অস্ট্রিয়ার দখলেই থেকে যায় । অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিক্টর ইমানুয়েল অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুরিখের সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন । কিন্তু ক্যাভুর পিডমন্ট সার্ডিনিয়ার অধিপতি ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে এই সন্ধি না মানার পরামর্শ দেন । কিন্তু ভিক্টর ইমানুয়েল তা অস্বীকার করলে ক্যাভুর পদত্যাগ করেন ।

মধ্য ইতালির সংযুক্তি

অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ইতালির টাস্কানি , পার্মা , মডেনা ও পােপ – শাসিত রােমে ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু হলে পােপ বাদে এই সমস্ত রাজ্যের শাসকবর্গ নিজেদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন । রাজ্যগুলি পিডমন্টের সঙ্গে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করলে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়ন ও অস্ট্রিয়া আপত্তি জানায় । এই সময় ক‍্যাভুরের চালে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়ন স্যাভয় ও নিস্ – এর বিনিময়ে রাজ্যগুলির সংযুক্তিতে আপত্তি তুলে নেন । ফলে গণভােটের মাধ্যমে টাস্কানি , পার্মা , মডেনাসহ মধ্য ও দক্ষিণ ইতালির অধিকাংশ অঞ্চল পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন ইতালির জন্ম দেয় । উত্তরে ভিনিসিয়া , মধ্যাঞ্চলে পােপের রাজ্য এবং দক্ষিণে নেপলস ও সিসিলি এইসব অঞ্চলগুলি নবগঠিত ইতালির বাইরে থাকে । শেষ হয় ইতালির ঐক্যের দ্বিতীয় ধাপ ।

দক্ষিণ ইতালি জয়

দক্ষিণ ইতালিতে ম্যাৎসিনির মন্ত্রশিষ্য বীর যােদ্ধা গ্যারিবল্ডি সিসিলি ও নেপলস জয় করে রােম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন । কিন্তু রােম আক্রান্ত হলে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ ছিল অবধারিত । এই অবস্থায় ক্যাভুরের পরামর্শে রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল নেপলসে উপস্থিত হলে গ্যারিবল্ডি তাঁর একনায়কত্ব ত্যাগ করে রাজ্য দুটি ইমান্যুয়েলের হাতে তুলে দেন । এক গণভােটে রাজ্য দুটি পিডমন্ট – সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টর ইমান্যুয়েল ইতালির রাজা হিসেবে ঘােষিত হন । ওই বছরই ৬ ই জুন ক্যাভুরের মৃত্যু হয় । দেহরক্ষার আগে এই মহান দেশপ্রেমিক বলেছিলেন ইতালি গঠিত হল , সকলই নিরাপদ (‘ Italy is made , all is safe ’) ।

মূল্যায়ন

যদিও জীবদ্দশায় ক্যাভুর ইতালির ঐক্যকে সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারেননি , তবে ‘ জাতি হিসেবে ইতালি যে ক্যাভুরেরই সৃষ্টি তা স্বীকার করতেই হবে । ক্যাভুরই হলেন আধুনিক ইতালির স্রষ্টা । লর্ড পামারস্টোন  বলেছেন — মাত্র ৫১ বছরের জীবনে ক্যাভুর যা করে গেছেন তা প্রায় উপকথার মতাে । রাষ্ট্র পরিচালক ও সংস্কারক ক্যাভুর ইতালিবাসীর প্রতি যে ভূমিকা পালন করে গেছেন , তা স্মরণ করে ঐতিহাসিক ই. লিপসন  বলেছেন – ক্যাভুর তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের মধ্যে দিয়ে ইতালিবাসীর জন্য ইতালিকে গড়ে তুলেছিলেন এবং তাদের চিরস্থায়ী কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন (‘ He ( Cavour ) lived long enough to create the Italy of the Italians and to earn the undying gratitude of the Italian people ’) ।

2 thoughts on “কাউন্ট ক্যাভুরের অবদান

  • Anonymous

    ক্যাভুরের চিন্তাধারার কথা কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!